কারাবন্দীদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই চলে আসে কয়েদী নারীদের অধিকার ও তাদের বিশেষ সুবিধার কথা। কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ২০০৬ সালে একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। আইনটির পুরো নাম, ‘কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা আইন–২০০৬’। এই আইনের ২(খ) ধারা মতে ‘কয়েদি’ অর্থ যে কোনো অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত নারী। আর হাজতী বলতে বুঝায় যারা বিচারাধীন মামলার আসামি। আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ধারা ৩ এর অধীনে সাজাপ্রাপ্ত নারীদের চার ধরনের বিশেষ সুবিধা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে– (ক) কোনো কয়েদির শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি; (খ) বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ যেমন– ব্লক বা বাটিক, সূচি শিল্প, হেয়ার কাটিং, বাঁশ ও বেতের কাজ, দর্জি বিজ্ঞান, কাপড়ের ফুল তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান; (গ) কারাগারের অভ্যন্তরে থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন ট্রেড কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েদিকে কারাদণ্ড ভোগের পর সমাজে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করার জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তর ‘কর্তৃক আফটার কেয়ার‘ সার্ভিস প্রদান; এবং (ঘ) সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বিশেষ সুবিধা হিসেবে ঘোষিত অন্য যে কোনো সুবিধা। ধারা ৪–এর বিধান মোতাবেক এই আইনের অধীন এক বছরের অধিক যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো কয়েদি রেয়াতসহ শতকরা ৫০% কারাদণ্ড ভোগের পর বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবে। ধারা ৫ অনুযায়ী, চার ধরনের কয়েদি এই আইনের অধীনে বিশেষ সুবিধা প্রাপ্তির অযোগ্য হবে– (ক) মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদি; (খ) যে কোনো অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদি; (গ) রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দণ্ডিত কয়েদি; (ঘ) বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, অস্ত্র আইন এবং মাদ্রকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট যে কোনো আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে দণ্ডিত কয়েদি। বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত কয়েদির জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলীর ক্ষেত্রে ধারা ১৪ বলছে, কোন কয়েদিকে এই আইনের অধীন বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হলে, তাকে তফসিলে উল্লিখিত ‘ছক’ অনুযায়ী একটি মুচলেকা কারাগার কর্তৃপক্ষের নিকট দাখিল করতে হবে। এবং বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য যে শর্ত নির্ধারণ করা হবে তা মুচলেকাতে উল্লেখ থাকবে এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত কয়েদি উক্ত শর্ত মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। কয়েদি প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধা বাতিল হতে পারে ধারা ১৫ অনুযায়ী। সেখানে বলা আছে, এই আইনের ধারা ১৪ এর অধীন প্রদত্ত কোন শর্ত কোন কয়েদি লঙ্ঘন করলে প্রবেশন অফিসার উক্ত শর্ত লংঘনের বিষয়ে জাতীয় কমিটি বা ক্ষেত্রমত, জেলা কমিটির নিকট বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এরপর কমিটি প্রতিবেদন বিবেচনাপূর্বক উক্ত কয়েদিকে ব্যক্তিগতভাবে শুনানীর সুযোগ প্রদান করে ক্ষেত্রমত, প্রদত্ত বিশেষ সুবিধা বাতিল করবার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর নিকট সুপারিশ পাঠাবে। আর প্রেরিত সুপারিশ অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রদত্ত বিশেষ সুবিধা বাতিল সংক্রান্ত প্রশাসনিক আদেশ জারি করবে। আইনের বিধান অনুযায়ী, এভাবে বিশেষ সুবিধা একবার বাতিল করা হলে কোনো কয়েদি পুনরায় বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবেন না।
ধারা – ১৬ রিভিউ ০১ –ধারা ১৫ অনুযায়ী এ অধীন কোন কয়েদির বিশেষ সুবিধা বাতিল করা হলে উক্ত কয়েদি বাতিল আদেশটি রিভিউ করার জন্য আদেশ প্রাপ্তির ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণলয় আবেদন করতে পারেন। ২) উপধারা ০১ অনুযায়ী কোন আবেদন করা হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উক্ত আবেদন বিবেচনা পূর্বক যথাযথ আদেশ প্রদান করতে পারবে এবং এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ধারা ১৭ প্রবেশন অফিসার এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণ কল্পে সরকার প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রবেশ অফিসার নিয়োগ করতে পারবে ২) উপধারা ১) এর অধীন প্রবেশন অফিসার নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়োগকৃত প্রবেশন অফিসারগণ এ আইনের উদ্দেশে পূরণকল্পে প্রবেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ৩) এ ধারার অধীন নিয়োগপ্রাপ্ত প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব ক্ষমতা ও কার্য পদ্ধতি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
উপরের নারী কয়েদীদের বিশেষ অধিকারগুলো তুলে ধরা হলো। সাধারণ নারী বন্দীদের ব্যাপারে আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেমন কোন কয়েদী বা হাজতী নারীকে অন্য মামলায় শোন এরেস্ট করা বা ২ দিনের বেশি পুলিশ রিমান্ডে না নেয়া। সূর্যাস্তের পর বা সূর্যোদয়ের পূর্বে কোনো নারীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না। কারাগারে মহিলা বন্দিদের জন্য স্যানিটারী ন্যাপকিন প্রবর্তন করা, দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
কারাগারে স্বাস্থ্যসেবা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় অনেকে নানা দুরারোগ্য ও সংক্রামক ব্যাধিতে ভুগতে থাকে। কারাবন্দিদের মানবাধিকার রক্ষায় কারা সংস্কারের মাধ্যমে তাঁর আধুনিকায়ন ও নারী কয়েদীদের যাবতীয় সুযোগ সুবিধার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরাধ নির্মূলে কারাগারকে বন্দীশালায় পরিণত না করে তাকে আধুনিক কারেকশন সেন্টারে পরিণত করতে হবে।
লেখক : আইনবিদ, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।