সিনেমায় ত্যাজ্যপুত্র কথাটি সবচেয়ে বেশি শোনা যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনও সিনেমার থেকে কম নাটকীয় নয়। ফলে অনেক সময় অভিভাবক ছেলের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। অনেকে হলফনামার মাধ্যমে নোটারি পাবলিকের সামনে সন্তানকে ত্যাজ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমাদের দেশের নাটক-সিনেমাতে তো ঘোষণা করা মাত্রই পুত্র ত্যাজ্য হয়ে যায়। সমাজেও ত্যাজ্যপুত্র ধারণাটি বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু প্রচলিত আইনে ত্যাজ্যপুত্রের ঘোষণার কোনো ভিত্তি নেই। এটি নিছক একটি ভ্রান্ত ধারণা। ত্যাজ্য বলে ঘোষণা করলেই পুত্র ত্যাজ্য হয়ে যায় না। এটি লোকমুখে প্রচলিত একটি শব্দ। আইন একে বৈধতা দেয় না। আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, যদি কোনো মা-বাবা তাঁর সন্তানকে ত্যাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন তবে সেই সন্তান চিরতরে তাঁর মা-বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। মুসলিম পারিবারিক আইনে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে কারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবেন এবং তাঁদের অংশ কতটুকু হবে। মুসলিম আইন অনুযায়ী জন্মসূত্রেই কোনো সন্তান তাঁর পরিবারের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার অর্জন করেন এবং তাঁদের এ অধিকার কোনোভাবেই খর্ব করা যায় না। মুসলিম পারিবারিক আইন ও হিন্দু আইন অনুযায়ী, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা কোনো চুক্তি নয়। এই সম্পর্ক বিবাহ, তালাক বা দাসমুক্তির মতো না। এটি চাইলেই যে কোনো সময় ভেঙে ফেলা যায় না। মনে রাখতে হবেু রক্তের সম্পর্ক কখনও মুখের কথায় পরিবর্তন করা সম্ভব নয়; এটি স্থায়ী বিষয়। বাবা-মা চাইলে তার সম্পদ থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারেন। তবে সন্তানদের ত্যাজ্য করে নয়। কেউ সন্তানকে ত্যাজ্য করলে তা ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়মেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এ ধরনের নীতিমালা ইসলাম ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।
ত্যাজ্যপুত্র বা কন্যা পিতা-মাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে কিনা?
আইনে ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজ্য কন্যার কোন বিধান নেই। পত্রিকায় ঘোষনা দিয়ে ঢোল পিটিয়ে কেউ পুত্র কন্যাকে ত্যাজ্য ঘোষনা করলেই তারা উক্ত ব্যক্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। তবে কোন পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে তাদের সমস্ত সম্পত্তি অন্য যে কোন ব্যক্তিকে সাফ কবলা মূলে রেজিষ্ট্রী বা দান ইত্যাদি করে দিতে পারবেন। এছাড়া শুধু ত্যাজ্যপুত্র কন্যা ঘোষণার কারণে কোন সন্তান তাদের মাতা-পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে আদৌ বঞ্চিত হবেন না। সন্তানকে মুখে বা স্ট্যাম্পে লিখে ত্যাজ্য পুত্র-কন্যা বললেই বা করলেই পুত্র-কন্যা ত্যাজ্য হয় না।
কে কে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্ছিত হয়?
ইসলাম ধর্মে ধর্মত্যাগী মুসলমানকে মুরতাদ বলে। একজন মুরতাদ তার মুসলমান আত্নীয়ের সম্পত্তি উত্তরাধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে যাবেন। পুত্র বা কন্যা যদি পিতা বা মাতাকে অন্যায়ভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলক্রমে হত্যা করে, তবে হত্যাকারী পুত্র-কন্যা নিহত পিতা বা মাতার ত্যাজ্য-সম্পত্তি হতে উক্ত হত্যাকারী পুত্র-কন্যা তৎ পিতা-মাতার ত্যাজ্য-সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হয়ে যাবেন। একই রূপে যেকোন ওয়ারিশ ব্যক্তি যদি তার পুর্ববর্তী সম্পত্তিওয়ালাকে হত্যা করে তবে সে নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশ থাকবেনা, এটাই মুসলিম ফরায়েজ আইনের বিধান, তাছাড়া মৃত্যুর আগে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিধিসম্মতভাবে তালাক কার্যকর হলেও একে অপরের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন।
খুনছা বা নপুংসক / হিজড়া ব্যক্তি কিভাবে সম্পত্তি পাবেন ?
যার মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয় প্রকারের লক্ষণ বিদ্যমান অথবা এতদুভয়ের মধ্যে হতে এক প্রকারেরও লক্ষন নেই, তাকে খুনছা বা নপুংসক বলে। এরূপ ব্যক্তি পুরুষ হলে যে অংশ বলে। এরূপ ব্যক্তি পুরুষ হলে যে অংশ পেত এবং নারী হলে যে অংশ পেত, এতদুভয়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম অংশটি পাবে। উদাহরণ স্বরূপঃ মনে করি জনৈক ব্যক্তি এক ছেলে, এক মেয়ে ও একজন নপুংসক রেখে মারা গেল। এখানে নপুংসক ব্যক্তি মেয়ের ন্যায় অংশ পাবে। কারণ, মেয়ের অংশটি কম। সুতরাং মোট সম্পত্তি চারিভাগে ভাগ করে দু’ভাগ ছেলেকে, এক ভাগ মেয়েকে এবং এক ভাগ নপুংসককে দেয়া হবে।
ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি পিতা বা মাতার ওয়ারিশ হিসেবে গণ্য হবে কিনা?
সনাতন হিন্দু ধর্মে আদি নিয়ম প্রচলিত ছিল যে, কোন হিন্দু ব্যক্তি ধর্ম ত্যাগ করলে তিনি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। সেই নিয়ম মোতাবেক ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি তৎ পিতা বা মাতার সম্পত্তিতে স্বত্ত্ব লাভের অধিকারী নন। হিন্দু ধমের্র বিধান অনুযায়ী পূর্বে ধর্মান্তরিত ও জ্ঞাতিচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো। কিন্তু দ্যা ক্যাসট ডিসএবিলিটিস রিমোভাল এ্যাক্ট, ১৮৫০ পাস হওয়ার পর থেকে উক্ত আইনের বুনিয়াদে ধর্মান্তরিত বা জ্ঞাতিচ্যুত ব্যক্তিগণ মৃত পিতা বা মাতার বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে এই আইনটি রিপেল (বাতিল) হয়ে যাওয়ায় ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তিগণ আর এই আইনের আওতায় পড়বেন না। এছাড়া দ্যা হিন্দু ইনহ্যারিটেন্স (রিমুভাল অফ ডিসএবিলিটিস) এ্যাক্ট, ১৯২৮ পাসের মাধ্যমে ধর্মচ্যুতিসহ উত্তরাধিকারের কিছু কিছু অযোগ্যতা/ অক্ষমতা দূরীভূত করা হলেও উক্ত আইনের বিধানাবলী হিন্দু দায়ভাগা মতবাদের (দায়াভাগা স্কুল অফ ল) অনুসারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য বাংলাদেশের বসবাসরত হিন্দুরা দায়ভাগা মতবাদের অনুসারী হওয়ায় উক্ত আইনের বিধানাবলী বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। প্রসঙ্গত আরো উল্লেখ্য যে, বোম্বে হাইকোর্টসহ ভারতীয় বিভিন্ন আদালত ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি ওয়ারিশ হওয়ার পক্ষে ইতিবাচক রায় প্রদান করলেও বাংলাদেশে অনুরূপ বিচারিক সিদ্ধান্তের নজির পুরোপুরি অনুপস্থিত। এমতাবস্থায়, বর্ণিত বিধিবদ্ধ আইন দুটির একটির অকার্যকারিতা এবং অন্যটির অ-প্রযোজ্যতার কারণে দায়ভাগ শাসিত অঞ্চলে ধর্মান্তরিত হিন্দু ব্যক্তি মৃত পিতা-মাতার স্বত্ত্বাধিকারী বা অংশীদার বলে বিবেচিত হবে না মর্মে অত্র বিভাগ মনে করে।
হিন্দুরা অন্যের পুত্রকে দত্তক গ্রহণ করিলে দত্তক পুত্র কি দত্তক পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন? দত্তক পুত্র আসল পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন? দত্তক সংক্রান্ত নিয়ম কি?
হিন্দু আইনে অন্যের পুত্রকে নিজের বলে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করাকে দত্তক গ্রহণ বা এডোপশন বলে। এজন্য সাবালক সুস্থ মস্তিস্ক হিন্দু পুরুষ ব্যক্তি তার কোন পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্র স্বাভাবিক বা দত্তকী অন্য কোন পুত্র না থাকলে দত্তক গ্রহণ করতে পারেন। দত্তক গ্রহণ শুধুমাত্র পুত্র সন্তান বা পুরুসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হিন্দু আইন মতে দত্তক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শারিরীকভাবে সমপ্রদান ও গ্রহণ হওয়া বাঞ্চনীয়। দত্তক গ্রহণের পর দত্তক পুত্র তার প্রকৃত পিতার সম্পত্তির ওয়ারিশ হন না এবং পিতৃদানও হতে পারেন না। দত্তক পুত্র তার দত্তক পিতার সম্পত্তির ওয়ারিশ হন এবং দত্তক পিতার বংশে পরিচিত হন। দত্তক পিতার পরবর্তীকালে পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে দত্তক পুত্র উক্ত প্রকৃত পুত্রের সম-অংশে দত্তক পিতার সম্পত্তির মালিক হন। স্বামীর হিতার্থে শুধুমাত্র পত্নী ব্যতিত অন্য স্ত্রী লোক দত্তক নিতে পারেনা। নিজের হিতার্থে স্ত্রীও দত্তক নিতে পারেনা। দত্তক গ্রহণকারী কুমার হলে কিংবা দত্তক গ্রহণকালে তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা হলেও দত্তক নিতে আইনে বাধা নেই। তবে কোনও ব্যক্তির পুত্র, পৌত্র বা প্রপৌত্র থাকলে দত্তক গ্রহণ অসিদ্ধ। পতি জীবিত থাকাকালে পতির লিখিত অনুমতি ব্যতিত পত্নী দত্তক গ্রহণ করতে পারেন না। একমাত্র পিতা মাতাই দত্তক প্রদান করতে পারেন। একভাই, অপরভাইকে, মাতা তার সৎপুত্রকে, পিতামহ তার পৌত্রকে দত্তক দিতে পারেনা। পিতা জীবিতকালে। তার অনুমতি ছাড়া মা পুত্রকে দত্তক দিতে পারে না। দত্তককে অবশ্যই পুত্র হতে হবে। একমাত্র পুত্র দত্তক গ্রহণযোগ্য নহে। অনাথকে দত্তক নেয়া যায় না। প্রচলিত সামাজিক প্রথা থাকলে নেয়া যায়। দুই ব্যক্তি একজনকে দত্তক নিতে পারে না। দত্তক গ্রহণের পর ঔরসজাত পুত্র ও দত্তক পুত্রের পিতার সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকারী হিন্দু আইনে দত্তক সম্পর্কিত এটাই সাধারণ নিয়ম। ক্ষেত্র বিশেষে এর ব্যতিক্রমও আছে। ইসলামী আইনে দত্তকের কোন বিধান নেই। অর্থাৎ ইসলামী আইনে পালক পুত্র উত্তরাধিকারসুত্রে সম্পত্তি পাবে না।
সুতরাং উপসংহারে বলা যায়, মুসলিম আইন অনুযায়ী, কাউকে ত্যাজ্যপুত্র করা বা মৃত্যুর সময় অসিয়তের মাধ্যমে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হারাম এবং অবৈধ। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। কাজেই যাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করা হয় কিংবা যাকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অসিয়ত করা হয়, সে কোনোভাবেই তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না । অন্যদিকে, হিন্দু আইনেও ত্যাজ্যপুত্র করার কোনো বিধান নেই। হিন্দু আইনে তাজ্য’ করে কোনো ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তির দাবি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। বাংলাদেশে মুসলিম বা হিন্দু কারো উত্তরাধিকার আইনই ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজ্যকন্যা ঘোষণার ধারণাকে সমর্থন করে না। অর্থাৎ এ ধরণের ঘোষণার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।
লেখক : আইনজীবী, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী ।