অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে

ডা. দুলাল দাশ | শনিবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

আমাদের একটা জাতীয় স্বভাব সেটা সরকারিভাবে হোক বা বেসরকারিভাবে হোক কোন কিছু ঘটে গেলে পর আমাদের চেতনা হয়, ঘুম ভাঙে। না ঘটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকি। জীবন হানি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ নিয়ে ইদানীং খুব মাতামাতি হচ্ছে। আমি বলি এটা দীর্ঘ দিনের ব্যাপার। এবারের ঘটনা হলো হাসপাতালের আই,সি,ইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) তে ৪১% রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্রেশন ডেভলাপম্যান্ট। অর্থাৎ রোগীর শরীরে প্রাণ রক্ষাকারী প্রতিষেধক ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। খবরটা খুবই মর্মান্তিক। ডাক্তাররা অসহায় বোধ করছেন। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে এ রূপ ঘটনা যে ঘটবে সেটা চিকিৎসক সমাজ থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন, সাধারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, গ্রাম ডাক্তার সবার নজরে থাকার কথা। প্রশাসন এখনও জেনে না জানার ভান করলে এভাবে সমগ্র জনগোষ্ঠীর উপর দুর্যোগ নেমে আসবে। যারা দেশের বাইরে থাকে তারা জানে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া পৃথিবীর কোন দেশে কোন ফার্মেসী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি করে না। শুধু আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। যখন জানা গেল আইসিউতে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না তখন সবার দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো। আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ অপব্যবহার দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন যদি কঠোর কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা না নেয়, এগুলি চলতে থাকবে। ১৮ কোটি লোক সংখ্যার দেশ বাংলাদেশ, হাটে, বাজারে, গ্রামে গঞ্জে, শহরে লক্ষ ওষুধের দোকান। তাতে নির্ভয়ে ওষুধ দোকানীরা অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছে। সেখানে না আছে মাত্রা, না আছে কতদিন খেতে হবে কথাটা। এভাবে আন্ডার ডোজ এবং অনিয়মিত ব্যবহারের ফলে ঐ রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যোন্স তৈরী হচ্ছে। তাই আইনের প্রয়োগ চাই। ভিজিল্যান্স টিম পাঠাতে হবে। প্রমাণ সাপেক্ষে স্পষ্ট জাজমেন্ট, লাইসেন্স বাতিল, সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে হবে। গ্রাম ডাক্তারদের কঠোরভাবে সাবধান করে দিতে হবে। আমাদের দেশে সব জায়গায় আইন আছে। তবে আইনের প্রয়োগ নাই। এটার পিছনে কারণ হতে পারে দুর্নীতি। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত বিক্রয় বন্ধ করতে হবে। আজকে বিক্রেতাদের দোষ দিচ্ছে, ডাক্তারদের দোষারূপ করছে, প্রায় ডাক্তাররা অবাধে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছে, ওষুধ দোকানদাররা অবাধে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছে। সত্য কথা বলতে কি এ ব্যাপারে কোনকালে কারো মাথা ব্যথা ছিল না। অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কোনও সময় কোনও কার্যকর ভূমিকা দৃশ্যমান হয়নি। বহির্বিশ্বে ব্যবস্থাপত্র ছাড়া একমাত্র প্যারাসিটামল টেবল্যাট বিক্রি হয়। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অবহেলার কারণে আজ দেশে নিরীহ রোগীরা চিকিৎসা বিভ্রাটে পড়ছে। তাদের জীবন সংকটাপন্ন। হাসপাতালের আইসিইউতে ক্রিটিক্যাল রোগীদের রাখা হয়। তারা প্রতিনিয়ত জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। সেখানে ৪১% রোগীর শরীরের জীবন রক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ যদি কাজ না করে তবে একবার ভাবুনতো রোগীরা কত সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে তাদের এ অবস্থা। এটা মারাত্মক এবং প্রাণঘাতি অপরাধ। সরকারের বেশ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে দেশ আজ সংকটে।

আমি ডাক্তারী প্রফেশন শুরু করি জানুয়ারী ১৯৬৯ সাল থেকে নোয়াপাড়া পথেরহাটে। তখনও দেখতাম গ্রাম ডাক্তারেরা নির্ভয়ে ডোজের তোয়াক্কা না করে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন ‘পেনিসিলিন’ কম্বায়োটিক রোগীদের ওপর ব্যবহার করছে। অ্যান্টিবায়োটিক রোগের মহা প্রতিষেধক ওষুধ। নির্দিষ্ট জীবাণুর ওপর নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। এটি শরীরে প্রদাহে ব্যবহৃত হয়। অপারেশন সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রয়োগ হয় এটি, যেমন জীবন রক্ষাকারী আবার এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই নিয়ম অনুযায়ী স্কিন টেস্ট করে বা কালচার সেনসিটিভিটি টেস্ট করে এটা প্রয়োগ করে থাকে। রেজিস্ট্যান্স কথাটার অর্থ হলো নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক যখন নির্দিষ্ট রোগ জীবাণু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয় তখন ঐ অ্যান্টিবায়োটিককে বলা হয় রেজিস্ট্রেশন। অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত এবং দরিদ্রজনগোষ্ঠী আমাদের দেশে অনেক আছে। তাদের মধ্যে ডাক্তারদের ফিদেওয়ার ভয়ে অনেক পরিবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। তাই তারা প্রথমেই ফার্মেসীতে চিকিৎসা নেয়। ফার্মেসীওয়ালা কয়েকটা ট্যাবলেট ক্যাপসুল দিয়ে বলেএগুলি খেয়ে দেখেন। এখানেই গণ্ডগোল। ডেইলি লেবার থেকে শুরু করে ২০%-২৫% লোক এটা করে। রোগীদের বলা হলো অ্যান্টিবায়োটিক ৭১০ দিন চলবে। আর রোগী কী করলো তিনদিনপর ভালো লাগলে নিজে নিজে ওষুধ বন্ধ করে দিল। যে মাত্রায় খেতে বললো সেটাও করল না। প্রাণী সম্পর্কে প্রচুর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। এই সমস্ত কারণে রেজিস্ট্যোন্স তৈরী হচ্ছে। বর্তমান কোনও কোনও রোগীর ক্ষেত্রে ২/৩ টা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হচ্ছে। রোগীদের খরচ বেড়ে গেছে। সুস্থ হতে সময় লাগছে। তার উপর ওষুধের চড়া দাম। রোগ হলে দিশেহারা হচ্ছে মানুষ। তাই গরীবদের উদ্দেশে বলি আপনারা সরকারি হাসপাতালগুলিতে যান। অন্তত সুনির্দিষ্ট একটা চিকিৎসা পাবেন। বিশেষজ্ঞদের মতে চিকিৎসা দ্রুত জটিল হচ্ছে। প্রতি চার নমুনায় একটিতে জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ প্রতিরোধী। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাকের বিরুদ্ধে নিত্যব্যবহারাহ্য ওষুধ কাজ করছে না। নিউমোনিয়া আক্রান্ত ৬৪ ভাগ শিশু প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। তাই ওষুধ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়কে আরও কঠোর অস্থানে যেতে হবে। রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রয় করা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়। সরকার যদি কার্যত এগিয়ে আসে বিজ্ঞানীদের গবেষণার আরো সুযোগ করে দেওয়া হয় তবে সম্ভব। এর সাথে ডাক্তারের ভূমিকা অনেক। বিশ্বে প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয় ‘পেনিসিলিন’ সম্ভবত ১৯২৮ সালের পর পর। নোবেল জয়ী ‘আলেক জান্ডার ফ্লেমিং’ এই কালজয়ী প্রতিষেধক অ্যান্টিবায়োটিক ‘পেনিসিলিন’ আবিষ্কার করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (যেটা ১৯১৪ সালে শুরু হয়েছিল) যোদ্ধাহত হাজার হাজার মৃত্যুপথযাত্রী সৈনিকদের প্রাণ রক্ষা করেছিল। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সময় ‘স্ট্যাফাইলো কক্কাস’ নামে এক জীবাণু নিয়ে গবেষণার সময় আকস্মিকভাবে জীবাণু নাশক এই ‘পেনিসিলিন’ আবিষ্কার করেন। বর্তমান যাদের বয়স ৫০ বছরের উর্ধ্বে তারা ইনজেকশন ক্রিস্টেলাইন পেনিসিলিনের প্রয়োগ দেখেছেন। এরপর আসে অ্যাম্পিসিলিন। শুরু হয় জেনারেশন আফটার জেনারেশন অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের দেশে আসতে থাকে। বিজ্ঞানের বদৌলতে এই প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলে মানব জীবন মহাসংকটে থাকতো। এটা সহজ লভ্য হওয়াতে আমরা এর যথেচ্ছ ব্যবহারকারী। বিশ্ব অ্যন্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহে অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিবেদন ২০২৪২০২৫ প্রতিপাদ্য ছিল ‘এখনই পদক্ষেপ নিন। আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করুন’। ‘আলেক জান্ডার ফ্লেমিংকে’ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি।

লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুকে স্বাস্থ্যবান রাখতে পুষ্টিরক্ষা কর্মসূচি
পরবর্তী নিবন্ধসার্ক-এর ভাঙন কি তাহলে আসন্ন!