প্রথমেই বলে রাখি অ্যানেস্থেসিয়া মেডিক্যাল সাইয়েন্সের একটা গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট। অ্যানেস্থেসিয়া সম্বন্ধে সাধারণ মানুষ তেমন পরিচিত নয়। যেমন অন্যান্য বিষয়ের উপর আছে। অপারেশনকালীন সময়ে রোগীর দেহে এটি প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়াও অন্যান্য প্রক্রিয়ায়ও এর ব্যবহার আছে। এটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিষয়। অ্যানস্থেসিয়া অর্থ চেতনানাশ, অজ্ঞান অবস্থায় নেওয়া বা অসারতা যার মাধ্যমে শল্য চিকিৎসকরা সুচারু ভাবে অপারেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এর সূচনা লগ্নে, অতীতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই ২০০০ বি,সি যখন ‘হার্বস’ এবং ‘উইন’ এর ব্যবহার করে প্লাস্টিক সার্জারী করা হতো, তেমনি দেখতে পাই বুড্ডিষ্ট রাইটিং ৫০০ বি,সি রোগীকে দাঁড়ানো অবস্থায় পিলারের সাথে টাইট করে বেঁধে পেটের অপারেশন, চিৎ করে ফেলে মাথার খুলীর অপারেশন করা হতো। হার্ব এবং অ্যালকোহল ব্যবহার করে ব্যথা নিবারণ করা হতো। এই গুলি এখন অবিশ্বাস্য ও ইতিহাসের নির্মম উদাহরণ। তারপর ১৮৪৬ সালে অ্যানেস্থেসিয়া সূচনা হয়। ১৯২০ সালে শুরু হয় ক্লোরোফর্ম এবং ইথারের ব্যবহার। অপারেশনকালীন সময়ে যে ঔষুধ মাংস শিথিল রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়, অনেক অনেক দিন আগে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান এলাকার বন মানুষেরা পশু পাখি শিকার করার সময় তীর ধনুকের মাথায় এক প্রকার গাছের পাতা ও ছাল ব্যবহার করতো। ঐ পাতা ও ছালের রস পশুর শরীরে প্রবেশ করে তাদের নিস্তেজ করে দিত এবং কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যেত। প্রাচীন কালে যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো ঐগুলি অমানবিক ও মৃত্যু ঝুঁকি ছিল বেশি। তখন অ্যানেস্থেসিয়া পদ্ধতি আবিষ্কারের অভাবে অনেক অপারেশন করা যেত না। রোগী বিনা অপারেশনে মৃত্যুর মুখে পতিত হতো। বর্তমানে মেডিক্যাল সায়েন্সের অন্যান্য বিষয়গুলি দিন দিন যেমন অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করছে অ্যানেস্থেসিয়া বিষয়টির ও অনেক উন্নতি সাধিত হয়েছে। এর প্রকার ও পদ্ধতিগত দিক উন্নতির ফলে বর্তমান ৯৯% ঝুঁকি মুক্ত। আধুনিক টেকনোলজি, মেশিনপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। দৈনন্দিন অ্যানেস্থেসিয়া এ্যাজেন্ট ও ঔষধ পত্র এতে সংযোজিত হচ্ছে।
অপারেশনকালীন সময়ে রোগিকে বেশি নিরাপদ রাখতে চেয়ে আধুনিক মনিটরিং সিস্টেম। অপারেশন কালীন সময়ে প্রতিটা মুহূর্ত রোগীর অবস্থা সম্বন্ধে ঐ কাজে নিয়োজিত একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্টকে অবহিত করে। উন্নত ও নিরাপদ অ্যানেস্থেসিয়া পদ্ধতির ফলে শল্য চিকিৎসকরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপারেশনের মাধ্যমে জটিল জটিল রোগকে সারিয়ে তোলছে। আজকে মেজর–মাইনর সব সার্জারীতে অ্যানেস্থেসিয়ার প্রয়োগ হয়। এক সময়ে রোগীকে চেপে ধরে ছোটখাটো অপারেশন করা হত। আজকাল বড় বড় জটিল আপেরেশন, কার্ডিয়াক সার্জারী (যেমন– হৃদপিণ্ডের অপারেশন) মস্তিষ্কের জটিল অপারেশন যেমন ব্রেইন টিউমার, স্পাইন্যাল সার্জারী (মেরুদণ্ডের অপারেশন), অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন, যেমন– কিডনী, হার্ট, যকৃত, হাঁড়, চোখের অপারেশন প্রভৃতি। এর সফলতার পিছনে অ্যানেস্থেসিয়ার বর্তমান পদ্ধতির অবদান অনেক। মাত্র কয়েক বছর আগে ইরানের দুই বোনের জন্মগত দুইমাথা লাগানো পৃথক করেছিল ৪৮ ঘণ্টা অপারেশন করে সিংগাপুরের এক হাসপাতালে। সম্ভব হয়েছিল অ্যানেস্থেসিয়ার বদৌলতে।
অ্যানেস্থেসিয়া পদ্ধতিগত দিকগুলো– (১) জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া (পুরো শরীরটাকে চেতনাহীন অজ্ঞান করে রাখা) (২) লোকাল– শুধু অপারেশনের যায়গাটা (৩) রিজিওন্যাল একটা এরিয়াকে অবস করা (৪) স্পাইন্যাল, এপিডুরেল (৫) ফুল রেঞ্জ নার্ভ ব্লক (৬) সারফেস–চামরার উপরিভাগ, প্রভৃতি।
এখানে স্পাইন্যাল অ্যানেস্থেসিয়া আজকাল খুবই জনপ্রিয়। এটা মেরুদণ্ডের নিচের অংশে দেওয়া হয়। নাভির নিচ থেকে পা পর্যন্ত সব অপারেশন এটাতে সম্ভব। এ পদ্ধতি অনেকটা নিরাপদ। যেমন– সিজারিয়ান অপারেশনে এই পদ্ধতি খুব বেশি ব্যবহার হয়। রোগীর পুরো জ্ঞান থাকে। তাই বাচ্চা বের করার সাথে সাথে মা কান্না শুনতে পায়। সহকারীরা বাচ্চাকে মায়ের মুখে এনে চুমু দেওয়ায়। যেহেতু অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার আগে পর্যন্ত রোগীর এ সম্বন্ধে কোনও ধারণা থাকে না তাই আমি মনে করি রোগীকে এ সম্বন্ধে ধারণা দেওয়া উচিৎ। কারণ অপারেশন থিয়েটারের পুরো পরিবেশ তার অজানা। এতে রোগী অভয় পায় ও সাহস সঞ্চয় করে। অ্যানেস্থেসিয়া দেওয়ার আগে–প্রি–অ্যানাসথেটিক চেক–আপ খুবই প্রয়োজন। যা সচরাচর করা হচ্ছে না। সেটা করা গেলে অ্যানেস্থেসিয়া হেজার্ড থেকে রোগী রক্ষা পায়। এটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটা সার্জন অপারেশনের আগে রোগীর অ্যানাসটেটিক ফিটন্সে পরীক্ষা করে থাকে। ল্যাবরেটরী পরীক্ষার মাধ্যমে তা করা হয়। যদি কোনও ক্রটি থাকে তবে রুগীকে চিকিৎসা দিয়ে ক্রটিমুক্ত করে, তবেই অপারেশন থিয়োটারে নেওয়া হয়।
মাঝে মাঝে মিডিয়া, সংবাপত্রে কিছু দুর্ঘটনার কথা শুনা যায়। তার পিছনে কিছু না কিছু কারণ থাকে। তবে বলতে চাই আধুনিক অ্যানেস্থেসিয়া পদ্ধতি রোগীদের জন্য অনেক নিরাপদ। শুধু সচেতনতা ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ববোধের দরকার। ভালো ট্রেনিং প্রাপ্ত ও অভিজ্ঞরা এই কাজে নিয়োজিত হওয়া উচিত। অপারেশন চলাকালীন সময়ে বর্তমান সব ও,টিতে যে মনিটরিং ব্যবস্থা চালু আছে তা কয়েক দশক আগেও কল্পনা করা যেতনা। ১৯৬৯ সালে যখন আমি অ্যানেস্থেসিয়ায় কাজ করি তখন আমাদের মনিটরিং সিস্টেম ছিল ব্লাড প্রেশার দেখা, শিরাগুনা, আংগুলের কালার দেখা, স্টেথেসকোগ দিয়ে হৃদস্পন্দন শুনা। তখন দুর্ঘটনাও ঘটত। এমনকি পালস অক্সিমেট্রি ও ছিল না যেটা করোনা কালে মানুষের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়েছে। এটাতে অক্সিজেনের মাত্রা রুগীর শরীরে কত সহজে বুঝা যায়। অক্সিজেন সেচুরেশন কমে যাওয়া মানে যে কোনও সময় হৃদস্পন্দ বন্ধ হযে যেতে পারে। এমনকি কর্ডিয়াক এ্যারেস্ট হয়ে রোগী টেবিলে মারা যেতে পারে। এখন ব্লাড গ্যাস এনালাইস মেশিন, নার্ড সেনসেশন লেভেল মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন বড় বড় ক্লিনিকে সরকারি ডিষ্ট্রিক্ট হাসপাতালে আই,সি,ইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট), সি,সি,ইউ (করনারী কেয়ার ইউনিট), এইচ,ডি,ইউ প্রভৃতি চালু রয়েছে। যদি কোনও রোগী অপারেশনকালীন বা অপারেশন শেষ হওয়ার সাথে সাথে অর্থাৎ পোস্ট অপারেটিব খারাপ হয়ে যায় সাথে সাথে রোগীকে আই.সি,ইউ/সি,সি,ইউতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলে। এই ডিপার্টমেন্টগুলোর পুরো দায়িত্বে থাকেন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। এখনও উপজেলা পর্যায় অ্যানেস্থেসিয়া অভাব রয়েছে। এর একটা কারণ ডাক্তাররা অ্যানেস্থেটিস্ট হতে চায় না। কারণ এ সাবজেকটা অবহেলিত এবং মূল্যায়ন হয় না। এই দিকে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া উচিৎ।
লেখক: প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট,
বাংলাদেশে রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।