প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সহযোগিতা বাড়াতে ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ স্বাক্ষরিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এতে প্রধান অতিথি ছিলেন। এ সময় তিনি এ গুরুত্বারোপ করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা যেমন উন্নত হওয়া জরুরি, তেমনি রোগগুলো যেন কম হয় অথবা না হয়, সেজন্য উপযুক্ত জনসচেতনতা এবং প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। তিনি স্বাস্থ্যকে কেবল চিকিৎসা খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং এটিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেয়ারও আহ্বান জানান।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদ দরকার। দক্ষ ও কর্মক্ষম মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারলে ব্যক্তিগত জীবন থেকে জাতীয় উন্নয়ন কোনোটাই যথাযথভাবে করা যাবে না। তাই যেকোনো পরিস্থিতিতেই হোক না কেন এবং যত চ্যালেঞ্জিংই হোক না কেন, আমাদের সুস্থ–সবল প্রজন্ম গড়ে তুলতেই হবে।’ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। ৩৫টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগ যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। অনুষ্ঠানে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবদের হাতে প্রধান উপদেষ্টা যৌথ ঘোষণাপত্র তুলে দেন। ঘোষণাপত্রে অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৭১ শতাংশই ঘটে অসংক্রামক রোগে এবং এর মধ্যে ৫১ শতাংশ অকালমৃত্যু ঘটে ৭০ বছরের নিচে। অসংক্রামক রোগ হলে মানুষ উচ্চ চিকিৎসা ব্যয়ের মুখোমুখি হতে বাধ্য হয় উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এগুলো কেবল স্বাস্থ্য সংকট নয়, বরং জাতীয় অগ্রগতির বড় অন্তরায়। ক্যান্সার বা জটিল অসুস্থতায় আক্রান্ত হলে পরিবারগুলো প্রায়ই আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় হয়। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি প্রতিরোধ ও সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে সরকারি–বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সেবার অগ্রগতি হলেও বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও তা নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত সোডিয়াম বা লবণ গ্রহণ, তামাকের ব্যবহার, কায়িক শ্রমের অভাব, বায়ুদূষণ প্রভৃতি কারণে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি বিকল, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যার মতো সমস্যাগুলো ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজের লক্ষ্য প্রত্যেক মানুষ যেন অর্থ ব্যয় ছাড়াই প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা সহজে পেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ু ও শব্দ দূষণের কারণে সৃষ্ট রোগসহ ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে একজন মানুষের ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। বিপর্যয়মূলক চিকিৎসা ব্যয় অসংখ্য রোগীকে দারিদ্রসীমায় ঠেলে দিচ্ছে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। এখন যেভাবে চলছে তাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে জোর দিয়ে এখনই স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত চ্যালেঞ্জ হবে।
তাঁরা বলেন, অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এসব ব্যাধি আজ মারাত্মক জনস্বাস্থ্যের সমস্যা, যেগুলো কখনো নির্মূল করা যাবে না। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার ও প্রতিরোধযোগ্য। রোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যত্নবান হতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যেহেতু একবার আক্রান্ত হলে এ ধরনের ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না, তাই সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধের বিকল্প নেই।