এটা এমন এক অতীতের কথা যখন শহরতলীর রাস্তার পাড়ে মিউনিসিপ্যালিটির কল থাকত। সময় হলে কল থেকে জল পড়ত। সেই জলে বিস্তর ধোয়া-পাখলা চলত, বিশেষত কাঁসার থালা-বাসন, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িকুড়ি ইত্যাদি। ভোরবেলা কল-পাড়ের এই ব্যস্ততা খুব উপভোগ করতাম আমি। কচুর পাতায় কখনো জমে থাকত শিশিরের ফটিক জল, মাঝে মাঝে দুয়েকটি মথ পোকা। আমার হাতে প্রায়ই থাকত একটি কঞ্চির লাঠি যা আদতে ছিল একটি কুড়িয়ে পাওয়া রাখাল-নড়ি। ঘুম থেকে উঠে সেটা হাতে নিয়েই শুরু হতো আমার সকাল। তেরচা বাড়ি দিয়ে কলপাড়ের কচুগাছ কেটে ফেলতাম আমি। একদিন এক মাসিমা বকলেন আমাকে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাসিমা সেই কচুর পাতাগুলো তুলে নিলেন হাতে। বকা খেলেও কচুর পাতা দিয়ে কী হবে সেই অনুসন্ধিৎসায় আমি তার পেছন পেছন হেঁটে গেলাম। বাড়িতে পৌঁছে বারান্দায় পাতাগুলো রাখার পর জিজ্ঞেস করলাম, পাতা দিয়ে কী হবে মাসিমা? তিনি জানালেন, ইলিশের মাথা দিয়ে ঘন্ট হবে।
কচু যতই বুনো হোক তা খাওয়া চলে, সিদ্ধ করে জল ফেলে দিতে হয় শুধু, কারণ তাতে থাকে ক্যালসিয়াম অকজ্যালেট। এই অকজালেট রয়েছে পালং শাক, মিষ্টি আলু, হেলেঞ্চা শাক এমনকি চায়ের ভেতরেও। এ-জাতীয় খাবার বেশি খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। এর জন্য অনেক সময় গলা-ধরা কচু রান্নাতে তেঁতুল, লেবুর রস ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এর ফলে অকজ্যালেটের সুঁইয়ের মতো চোখা ‘র্যাফাইড ক্রিস্টালগুলো গলে যায়, গলা-চুলকানি কম হয়। ‘যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল’ বাংলার এই বাগধারাটি সে-জন্যই তৈরি হয়েছে।
বকেছেন বলে মাসিমা এবার একটু আদর করলেন আমাকে, খেতে দিলেন নাড়কেলের নাড়ু। আমার চোখ পড়ল উঠানের কিনারে। সেখানেই প্রথম দেখা স্থলপদ্ম, তুলসি আর নানা রকম অলংকৃত কচুর। হরেকরকম গাছগাছালি ঘেরা মাসিমার বাড়িটা ছিল আমার উদ্ভিদবিদ্যার প্রথম পাঠ। বয়স তখন এত কম যে ভালো করে কথা বলা আয়ত্ত হয়নি কিন্তু স্বভাবসুলভ ‘এটা কী ওটা কী’ প্রশ্ন করা শিখেছি। উঠানের কিনার দিয়ে অদ্ভুতরকম কচুর গাছ। কোনো কোনো কচুর পাতায় লাল আর সাদা ফোঁটা, মনে হয় কেউ হাত দিয়ে চুন আর সিঁদুর লাগিয়েছে। মাসিমা বললেন ওগুলো ছিট-কচু। কিছু কচুর শির বরাবর লাল সিঁদুরের মতো, মাসিমা বললেন ‘সাবিত্রী কচু’। আমি তখন জিজ্ঞেস করি, সাবিত্রী কী মাসিমা? তিনি বললেন, সধবা। আমি আবার জিজ্ঞেস করি ‘সধবা’ কী? মাসিমা এত প্রশ্নেও বিরক্ত না হয়ে মুচকি হাসলেন, সধবা মানে যাদের ‘ধবা’ আছে, মানে স্বামী আছে। যাদের ধবা নেই তারা হলো বিধবা। তারপর তিনি তার সিঁদুর দেখালেন, কচুর শিরার সঙ্গে যার বেশ মিল আছে। পরবর্তীকালে আমি সধবার বিপরীতে বিধবা-কচুও দেখেছি যেগুলোর শিরা দেখতে সাদা। বাংলাদেশে সাবিত্রী কচু (Caladium sp.), সধবা বা বিধবা কচু নামের চল সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। জীবনে এরপর আর কখনো শুনেছি বলেও মনে পড়ে না। শব্দগুলো কলকাতার আঞ্চলিক হতে পারে, কারণ মাসিমার কলকাতা যাওয়া-আসা ছিল।
কচু পরিবার (Araceae) খুবই বিস্তৃত যার ১১৪টি জেনাসে প্রজাতির সংখ্যা ৩৭৫০। খাদ্য হিসাবে এর ব্যবহার যে কত হাজার বছরের পুরানো তা অনুমান করা দুঃসাধ্য। ক্যালেডিয়াম (Caladium), আলোকেসিয়া (Alocasia), কলোকেসিয়া (Colocasia), জ্যানথোসোমা (Xanthosoma) সবই কাছাকাছি জেনাসের কচু-জাতীয় গাছ। এদের সাধারণ ইংরেজি নাম ‘এলিফ্যান্ট ইয়ার’ কিংবা ‘অ্যাঞ্জেল উইং’। ক্যালেডিয়াম দক্ষিণ আমেরিকার গাছ, দেশীয়করণ হয়ে বিস্তার লাভ করেছে আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশে। এগুলো বিচিত্র বর্ণের নকশাদার কচু যা অলঙ্কার হিসাবে ঘরে বাইরে ভূদৃশ্যে ব্যবহৃত হয় বিশ্বব্যাপী। এই গাছের পাতা বা কন্দ খাওয়া যায় না, দেখেই মনে হয় বিষাক্ত। কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ অস্বাভাবিক রঙের হলে তা আমরা প্রায়শ বিষাক্ত ভাবি। প্রাণীদের মধ্যে প্রজাপতি, সবুজ ব্যাং, উদ্ভিদের মধ্যে হেমলকের রক্তমাখা কাণ্ড এর উদাহরণ। (চলবে)