সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার পর বাড়বে দারিদ্র্য। কোভিড-১৯-এর কারণে বিশ্বজুড়েই যে অর্থনৈতিক মন্দার হাওয়া বইছে, বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে অর্থনৈতিক ধাক্কা। গবেষণা বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষ। সারাদেশেই বাড়তে থাকবে দারিদ্র্যের প্রবণতা। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ র্যাপিড রেসপন্স গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা বলছে, শহরের রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রেস্টুরেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র ভাসমান ব্যবসায়ী, অটোচালকদের সঙ্গে গ্রামের কৃষক, জেলে, দোকানি, বিদেশফেরত মানুষেরা এই সময়ে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়তে চলেছেন।
কিন্তু আমাদের সরকার অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন। শেখ হাসিনা সরকারের গত দশ বছরে নেওয়া নানা উদ্যোগ আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় দারিদ্র্য বিমোচন ঘটছে দ্রুত। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বে এখন হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৭৭ কোটি। যাদের দৈনিক আয় এক দশমিক ৯০ ডলারের কম। তাদের মধ্যে ৫১ শতাংশ বা ৩৯ কোটির বসবাস সাহারা অঞ্চলে। আর ৩৪ শতাংশের বসবাস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ঠিক এর বিপরীত অবস্থানে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ। ২০০৫ সালেও দেশে যেখানে হতদরিদ্রের হার ছিল ৪৩ শতাংশ, দশ বছরের ব্যবধানে তা কমে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্বের খুব কম দেশই এমন সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে। তাই বাংলাদেশ আজ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিশ্বের সামনে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ যে এক অনুকরণীয় অবস্থানে পৌঁছেছে, তার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করেছে বহুমাত্রিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক। তারা বলছে, বিশ্বের অন্য উন্নয়নশীল দেশের উচিত কীভাবে দারিদ্র্য দূর করতে হয়, তা বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখা। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশটি অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে। বাংলাদেশের এই ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ জাতিসংঘকেও বিস্মিত করেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অবশ্য ষোলো কোটির বেশি দেশের জনসংখ্যার মধ্যে তিন কোটি এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আবার এর মধ্যে এক কোটি মানুষ অতি দরিদ্র। দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এলেও দারিদ্র্য দূরীকরণ এখনও সরকারের মূল লক্ষ্য। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে উন্নতির ধারা বজায় রাখতে হবে আগামী সাত থেকে দশ বছর, তবেই দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে দশ ভাগের নিচে। সারাদেশে বছরে দারিদ্র্য কমানোর হার এখনও দুই শতাংশের নিচে রয়েছে। এই হার দুই শতাংশে নেয়া গেলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব হবে আগামী দশ বছরের মধ্যে। তাই দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য এই দশ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদ বলছেন, ‘দারিদ্র্য দূরীকরণে সামগ্রিক ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, দারিদ্র্য একটি রাজনৈতিক ইস্যু এবং এটা দূর করতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা এবং ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। যুক্তরাজ্যের বাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর জিওফ উড বলেন, দারিদ্র্য কেবল একটি টেকনিক্যাল ইস্যু নয়, এটা একটি রাজনৈতিক ইস্যুও। যদি এ দুটোকে আলাদা করে দেখা হয়, তাহলে কোনো কর্মসূচিই যথাযথ ফল দেবে না। সব পলিসি একত্রে দেখতে হবে এবং সমন্বিতভাবে কার্যকর করতে হবে। মাইক্রোফিন্যান্স বা ক্ষুদ্রঋণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর দ্বারা অতি দরিদ্রদের সমস্যার সমাধান করা যায় না। তারা বাদ পড়ে যায়। তার মতে, দারিদ্র্যবিমোচন নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। রাজনৈতিক অর্থনীতি দরিদ্র জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে। দারিদ্র্য দূরীকরণে যে সামগ্রিক কর্মসূচি নিতে হবে, সে ব্যাপারে অনেকে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। শহরের দরিদ্রদের বিষয়টিও এর অংশ হতে হবে। পথশিশুদের ব্যাপারটিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
দারিদ্র্যের পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হলো, আমাদের সম্পদের সুষম বণ্টন নেই। দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে দারিদ্র্য কমাতে সরকার যেভাবে এগোচ্ছে, তাকে প্রশংসা করে বলতে হয়, এর জন্য গ্রহণ করতে হবে আরো নানামুখী পদক্ষেপ। নিশ্চিত করতে হবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ।