উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বিখ্যাত ট্রাজেডি ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৯৪ খ্রিস্টাবে, মতান্তরে ১৫৯৭ খ্রিস্টাব্দে। পরবর্তীতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে চিত্রকর্মসহ এর সংস্করণ বের হয়। এ ধরনের একটি সংস্করণ শোভা পেত লালদীঘি পাড়ে ১১৬ বছরের পুরনো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরিতে। এছাড়া ১০০ থেকে ১৫০ বছর আগে প্রকাশিত ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের দুষ্প্রাপ্য বিভিন্ন বই, সাময়িকী, ব্রিটিশ আমলের দলিল, গেজেট, প্যাটেন্টসহ দুষ্প্রাপ্য নানা গ্রন্থ এ লাইব্রেরিতে সাজানো ছিল। প্রাচীন এসব সংগ্রহের টানে লাইব্রেরিতে ছুটে আসতেন পাঠক এবং গবেষকগণ। অথচ গত তিন বছর ধরে দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য বইগুলো বস্তাবন্দি হয়ে আছে বিবিরহাট সিটি কর্পোরেশন আরবান হেলথ কমপ্লেক্স সেন্টারে।
লালদীঘির দক্ষিণ পাড়ে লাইব্রেরি ভবনটি ভেঙে জাইকার অর্থায়নে আট তলা ভবন নির্মাণ করেছে চসিক। ১৪ কোটি ১৭ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৫ টাকায় নির্মিত ভবনটি গত ২৬ জুলাই উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। এমনকি বিবিরহাট থেকে বইগুলো নিয়ে আসার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে সেখানে বস্তাবন্দি বইগুলো নষ্ট হচ্ছে। নতুন ভবন নির্মাণের আগে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে পাবলিক লাইব্রেরির প্রায় ৩৫ হাজার বই সংরক্ষণের জন্য এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল।
সরেজমিন চিত্র : গতকাল বিকেলে বিবিরহাটে সিটি কর্পোরেশন আরবান হেলথ কমপ্লেঙ সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, তিন তলার বিভিন্ন কক্ষে বস্তাবন্দি পড়ে আছে বই ও সাময়িকী। লাইব্রেরির বিভিন্ন আসবাবপত্রও পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়। একটি কক্ষে ঢুকে দেখা গেছে, বস্তা এবং তাকের উপর বিভিন্ন বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। সেখানে দায়িত্বরত এক কর্মচারী জানান, ছাদ থেকে চুঁইয়ে পড়া পানিতে বস্তা ও বই ভিজে যায়। তাই শুকাতে দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, তিন বছর আগে বস্তাবন্দি করার পর বইগুলো খোলা হয়নি। তাই অনেকগুলো বই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। ইঁদুরেও কেটে ফেলতে পারে কিছু বই। ছত্রাক পড়েও নষ্ট হতে পারে।
ফিরে দেখা : ১৯০৪ সালে পাবলিক লাইব্রেরিটির যাত্রা শুরু হয়। এটি ছিল চট্টগ্রামের প্রথম পাবলিক লাইব্রেরি। তখন এর নাম ছিল ‘চিটাগাং মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরি’। যে ভবনে লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয় ওই ভবনটি ১৮৫৮ সালে চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। পৌরসভার অফিস ১৯২৩ সালে আন্দরকিল্লায় স্থানান্তর করা হলেও পাবলিক লাইব্রেরি লালদীঘিতে থেকে যায়।
২০১৭ সালে লাইব্রেরি ভবনটি ভেঙে সেখানে আধুনিক বহুতল ভবন নির্র্মাণের উদ্যোগ নেয় চসিক। এ জন্য গ্রহণ করা হয় ‘রি-কনস্ট্রাকশন অব লালদীঘি সেন্ট্রাল ডিজেস্টার ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল অফিস লাইব্রেরি অ্যান্ড কমিউনিটি কাম সাইক্লোন শেল্টার’ নামে একটি প্রকল্প। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর ১২ কোটি ৯৭ লাখ ২৯ হাজার ৪৩৯ টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। পরবর্তীতে প্রাক্কলন সংশোধন করলে ব্যয় ১৪ কোটি ১৭ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৫ টাকায় উন্নীত হয়। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ছিল। অবশ্য কয়েক মাস আগে আটতলা ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আলাদা সাব স্টেশনের কাজ চলছে। যদিও পুরাতন বিদ্যুৎ সংযোগ বহাল থাকায় তেমন সমস্যা হচ্ছে না।
গতকাল সকালে লালদীঘি পাড়ে ভবনটিতে দেখা যায়, প্রধান ফটকে ভেতর থেকে তালা মারা। সেখানে কয়েকটি মাইক্রোবাস পার্কিং করা ছিল। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর এগিয়ে আসেন নিরাপত্তা কর্মী আবুল কাশেম। তিনি নিজেকে ঠিকাদারের লোক পরিচয় দেন। এর বেশি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নতুন নির্মিত ভবনের চতুর্থ তলার ১৬ হাজার বর্গফুট জায়গায় লাইব্রেরি চালু করা হবে। একই ফ্লোরে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, মিনি ক্যাফে ও প্রশাসনিক কক্ষও থাকবে। এছাড়া ভবনটির প্রথম তলায় কমিউনিটি সেন্টার, দ্বিতীয় তলায় কেন্দ্রীয় দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, তৃতীয় তলায় শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পঞ্চম তলায় ফুটবল ও অন্যান্য ক্লাব, ষষ্ঠ তলায় পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা জিমনেশিয়াম এবং অষ্টম তলায় গেস্ট রুম থাকবে।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন : ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হোসেন অ্যান্ড ব্রাদার্সের স্বত্ব্বাধিকারী আলী হোসেন আজাদীকে বলেন, ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ২৬ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে সিটি কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন আজাদীকে বলেন, ডিসেম্বর মাসে বিজয় দিবসের দিন লাইব্রেরি চালুর পরিকল্পনা আছে। ইতোমধ্যে লালদীঘি পার্ক আধুনিকায়ন করে উন্মুক্ত করেছি। লালদীঘি মাঠকে ঘিরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর চমৎকার কাজ করেছে। লাইব্রেরি চালু হওয়ার পর লালদীঘি চত্বর জ্ঞানভিত্তিক বিচরণ কেন্দ্রে পরিণত হবে।
বস্তাবন্দি বই নষ্ট হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বইগুলো নিয়ে যেতে বলেছি। এর আগে রোদে শুকাতে দিতেও নির্দেশনা দিয়েছি।
সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির সহকারী লাইব্রেরিয়ান সৈয়দা পারভীন আজাদীকে বলেন, রেজিস্টার স্টকে ৩৮ থেকে ৪০ হাজার বই আছে। তবে সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই নিয়ে যায়। তাই এখন আনুমানিক ৩৪ থেকে ৩৫ হাজার বই আছে। প্রাচীন চিত্রকর্মে রোমিও-জুলিয়েটর ১ম সংস্করণ সংগ্রহে আছে। সেটা আমরা দুই ভাগ করে লেমেনেটিং করে রেখেছি। ইংরেজি সাহিত্যের দেড়শ থেকে দুইশ বছরের পুরনো বইও আছে। এগুলো বিভিন্ন সময়ে মেলায় প্রদর্শনও করেছি।
বস্তাবন্দি থাকার কারণে কী পরিমাণ বই নষ্ট হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন বলা যাচ্ছে না। তবে শঙ্কা আছে। যেহেতু পুরাতন বই, তাই নষ্ট হতে পারে। কারণ এখন কাগজের মান উন্নত। তখনকার বইয়ের কাগজের মান এত ভালো ছিল না।
চসিকের লাইব্রেরি উপ-কমিটির সাবেক আহ্বায়ক ও চকবাজার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সাইয়্যেদ গোলাম হায়দার মিন্টু আজাদীকে বলেন, যেহেতু এখন প্রশাসক সবকিছু দেখছেন তাই তার কাছে অনুরোধ থাকবে লাইব্রেরিটি সুন্দরভাবে গুছিয়ে দেওয়া হোক। সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৩০০ বছরের পুরনো দুইটা বই আছে। ১০০ বছরের পুরনো বই আছে সোয়া তিনশর মতো। কাজেই এটা অনেক সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।
চসিকের গণসংযোগ কর্মকর্তা আবুল কালাম চৌধুরী দীর্ঘদিন সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে অনেক সময় পুরাতন গেজেটের জন্য লাইব্রেরিতে লোকজন আসতেন। দেশের অনেক জায়গায় সংগ্রহে ছিল এমন গেজেটও এখানে আছে। বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে দুর্লভ অনেক সংগ্রহ এখানে আছে।