অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

পিংকু দাশ | মঙ্গলবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

মাতৃভাষা প্রত্যেক জাতির কাছেই অতি আদরের। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের সূর্যসন্তানেরা প্রাণ দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি আমাদের অবধারিতভাবে মনে করিয়ে দেয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের কথা,ভাষা আন্দোলনের কথা।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই বিতর্কের সূত্রপাত। বাংলা নাকি উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দেশভাগের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা মনোভাব প্রকাশ করেন যে একমাত্র উর্দুই হবে নুতন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালিকে তাদের অধীন করে রাখার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে বাঙালিদের ভুলিয়ে দিতে চায় তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়।অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানান। ভাষা আন্দোলনকে সাংগঠনিক রূপ দিতে ১৯৪৮ সালের ২ রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফজলুল হক হলে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ২১ শে মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। অন্য কোন ভাষা নয়।এর প্রতিবাদে ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে।ঐদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের উপর গুলি চালায়।এতে শহীদ হন আবুল বরকত,আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালামসহ আর ও কত নাম না জানা বাংলা মায়ের দামাল ছেলে ।এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুদ্ধ বাংলার লোক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলে সমবেত হয়। নানা নির্যাতন অগ্রাহ্য করে দেশের ছাত্র জনতা, প্রতিবাদ জানাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য ২৩ ফেব্রুয়ারি এক রাতের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোষ্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। যা সরকার ২৬ শে ফেব্রুয়ারি গুড়িয়ে দেয়।এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আর ও বেগবান হয়।১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট এর বিজয়ে ৭ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ এর অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয় ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি।
জাতিসংঘের স্বীকৃতির ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালিত হচ্ছে সারাবিশ্বে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেস্কোর ৩০ তম অধিবেশন বসে। ইউনেস্কোর সেই সভায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব আসে। ফলে পৃথিবীর সব ভাষাভাষীর কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি একটি উল্লেখযোগ্য দিন হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের দরবারে বাংলাভাষা লাভ করে বিশেষ মর্যাদা। ২০০০ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮৮ টি দেশে এ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে মর্যাদা লাভ শুধু বাংলা ভাষার বিশ্ববিজয় নয়, পৃথিবীর সব মাতৃভাষার বিজয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশের বাণী
পরবর্তী নিবন্ধপ্রত্যাশার নগরী দেখতে চাই