অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য পরিবহনে বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ

সিরিয়াল প্রথা প্রবর্তনসহ বিরাজমান সংকট নিরসনে এই পদক্ষেপ খসড়া বিধিমালা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আজ বৈঠক

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৬ জুলাই, ২০২৪ at ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে সিরিয়াল প্রথা প্রবর্তনসহ বিরাজমান সংকট নিরসনে সরকার একটি বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। একাধিক বৈঠকের পর তৈরি করা খসড়া বিধিমালা নিয়ে আজ মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। প্রস্তাবিত নয়া বিধিমালা নিয়ে পক্ষ বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনা তীব্র হয়ে উঠার পাশাপাশি বিরোধও নয়া মাত্রা পাচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে বছরে প্রায় দশ কোটি টন পণ্য পরিবাহিত হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহনে অন্তত ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজের চলাচল ও সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের জন্য লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠন যথা বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভ্যাসেল ওনার্স এসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) এর সমন্বয়েই ডব্লিউটিসি গঠন করা হয়। মাস কয়েক আগে জাহাজ মালিকদের বিরোধের জের ধরে ভেঙ্গে যায় ডব্লিউটিসি। গঠিত হয় আইভোয়াক নামের পৃথক একটি নয়া সংগঠন। কিন্তু তাতেও সংকটের সুরাহা না হওয়ায় নৌ পরিবহন অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রামস্থ নৌ বাণিজ্য দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে একটি সেল গঠন করে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু আবারো পক্ষে বিপক্ষে অবস্থানের কারণে সেই উদ্যোগও ভুণ্ডুল হয়ে যায়। কোন উদ্যোগই কার্যকর না হওয়া এবং জাহাজ মালিকদের সংগঠনের নেতাদের বিরোধের মুখে দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটিতে বিশৃঙ্খলা অব্যাহত থাকে।

বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে দফায় দফায় বৈঠক এবং নানাভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তী নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করে লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। কয়েক দফা বৈঠক করে ইতোমধ্যে একটি খসড়া বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তর হতে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমদ্র বন্দরসমূহে পণ্য পরিবহন বিধিমালা, ২০২৪ নামের উক্ত বিধিমালায় লাইটারেজ জাহাজসমূহ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহ ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, নির্বিঘ্ন ও সুশৃঙ্খলভাবে পণ্য পরিবহন করার স্বার্থে দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিনেন্স ১৯৭৬ এর সেকশন ৮২ এবং দ্য বাংলাদেশ মার্চেন্ট শিপিং অর্ডিনেন্স ১৯৮৩ এর সেকশন ৫০৬ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। লাইটার জাহাজগুলোকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার মাধ্যমে লাইটার জাহাজ শিল্প এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের একটি সমন্বিত বিধিমালার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে লাইটারেজ জাহাজ দ্বারা পণ্য পরিবহন সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করার পাশাপাশি সুষম ও স্বচ্ছ ক্ষেত্র প্রস্তুতপূর্বক জবাবদিহিমূলকভাবে লাইটার জাহাজ পরিচালনা, স্বল্পতম সময়ে লাইটার জাহাজ বরাদ্দ ও মোতায়েন, খাদ্য পণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, সারসহ সকল আমদানীরপ্তানী পণ্য যথাসময়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে সুষম সরবরাহে সহায়তা করার জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়। বিডব্লিউটিসিসি নামের সংগঠনের মাধ্যমে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ বাণিজ্য সংগঠন আইন, ২০২২ বা উক্ত আইনের আওতায় প্রণীত বিধির আলোকে সংগঠিত নৌযান মালিক সংগঠন এবং নৌ শিল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারক হিসেবে বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসি গঠন করা হবে। দেশের জলসীমায় আগত জাহাজ, মাদার ভেসেল থেকে সুষ্ঠুভাবে পণ্য বোঝাই এবং খালাসের জন্য লাইটার জাহাজ বরাদ্দ ও মোতায়েনের নিমিত্ত ডব্লিউটিসিসি সমন্বয়কারকের দায়িত্ব পালন করবে। বিডব্লিউটিসিসি লাইটার জাহাজ বরাদ্দ, মোতায়নে লাইটার জাহাজ মালিক, আমদানীরপ্তানীকারক, পণ্যের এজেন্ট ও লোকাল এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সমন্বয়কারক হিসেবে কাজ করবে। বিডব্লিউটিসিসির সার্বিক কার্যক্রম তদারকির জন্য নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে একটি তদারকি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তর, নৌবাণিজ্য দপ্তর, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টম হাউজ, চট্টগ্রাম এবং লাইটার জাহাজ মালিক সংগঠনের প্রতিনিধিগণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

খসড়া বিধিমালায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি, নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার, বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি, বাংলাদেশ কোস্টাল শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি, ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অব চট্টগ্রামের সভাপতি, বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফেকচারার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি, কাস্টমস কমিশনারের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি কমিটির সদস্য থাকবেন। নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটির সভাপতি প্রয়োজনে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়। এই কমিটি বিডব্লিউটিসিসির জনবল নিয়োগ, হিসাব নিরীক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম, লাইটার জাহাজ বরাদ্দ, পরিচালনা কার্যক্রম ও দায়বদ্ধতা, আমদানীরপ্তানীকারক কর্তৃক আমদানী রপ্তানিকৃত পণ্যের প্রকৃত ঘোষণা যাচাই, বিভিন্ন গন্তব্যে ভাড়ার হার নির্ধারণ, আমদানী রপ্তানীকারক, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক, জাহাজ মালিক বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, ডেমারেজ ও ডেসপাস হার নির্ধারণ ও পুনঃনির্ধারণ প্রভৃতি কার্যক্রম তদারকি করবে। বিডব্লিউটিসিসির বরাদ্দ ছাড়পত্র ব্যতীত কোনো লাইটার জাহাজ দেশের কোনো সমুদ্র বন্দর, সমুদ্র উপকূলীয় নদী বন্দর ও নদীর উভয় পাড়ে অবস্থিত সকল প্রকার জেটি, সমুদ্রে নোঙরে আগত মাদার ভেসেল থেকে পণ্য পরিবহন করতে পারবে না। এই নির্দেশনা অমান্য করলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক উক্ত লাইটার জাহাজের সার্ভে, উপকূল অতিক্রমের অনুমতি পত্র বাতিল কিংবা স্থগিত করতে পারবেন। তবে যে সকল আমদানীরপ্তানিকারক বা শিল্প প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লাইটার জাহাজ রয়েছে, সেক্ষেত্রে বিডব্লিউটিসিসির অব্যাহতি পত্র সাপেক্ষে তাদের নিজস্ব পণ্য কেবল মাত্র নিজস্ব জাহাজে পরিবহন করতে পারবে। বিডব্লিউটিসিসি জাহাজ বরাদ্দ বা মোতায়েনের উদ্দেশ্যে ছাড়পত্র প্রদানের জন্য ফি নির্ধারণ করতে পারবে। ছাড়পত্র চার্জ হতে আদায়কৃত অর্থ দ্বারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সমস্ত ব্যয় নির্বাহ করা হবে। এ সংক্রান্ত তহবিল বাৎসরিক ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নিরীক্ষা ফার্ম দ্বারা নিরিক্ষিত হবে।

আমদানীরপ্তানি পণ্য খালাস ও লোডিং এর নিমিত্ত বিডব্লিউটিসিসি জাহাজ বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রে ক্রম তালিকা বজায় রাখবে। ফ্যাক্টরির মালিকগণ কোন অবস্থাতেই নিজ মালিকানার বাহিরে জাহাজ ভাড়া করে অথবা অন্য কোন পন্থায় জাহাজ সংগ্রহ করে নিজস্ব বহর বৃদ্ধি করতে পারবেন না। যদি অতিরিক্ত লাইটার জাহাজের প্রয়োজন হয়, তবে বিডব্লিউটিসিসি এর মাধ্যমে বরাদ্দ নিতে হবে। আরো বিভিন্ন ধরণের শর্ত ও ধারা উপধারা যুক্ত করে খসড়া বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই বিধিমালা নিয়ে আজ বেলা ১২টায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠাতব্য আজকের বৈঠকে সংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

খসড়া বিধিমালা নিয়ে ইতোমধ্যে লাইটারেজ জাহাজ মালিক, আমদানিকারক এবং বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ডব্লিউটিসির আদলেই এই বিধিমালা প্রণয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের ভাষায় আমাদের জাহাজ কিভাবে চালাবো সেটি আমাদের বিষয়। বিধিমালার নামে আমাদের উপর বিতর্কিত ডব্লিউটিসির নিয়ম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গত ২৫ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বের হয়ে যান বলে উল্লেখ করে লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের একাংশের নেতা পারভেজ আহমেদ বলেন, আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যা কোনমতেই সুফল বয়ে আনবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। আজকের বৈঠকে যোগ দিয়ে তিনি বিষয়গুলো বিস্তারিত তুলে ধরবেন বলেও দৈনিক আজাদীকে জানিয়েছেন।

একাধিক আমদানিকারক বলেছেন, আমরা পণ্য আমদানি করি। আমাদের পণ্য আমরা কোন জাহাজে পরিবহন করবো তা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। আমদানিকৃত পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে আমদানিকারকদের স্বাধীনতা থাকা উচিত বলেও তারা মন্তব্য করেন। তবে কয়েকজন জাহাজ মালিক বলেছেন, কোন ধরণের নিয়ন্ত্রন না থাকায় সাধারণ জাহাজ মালিকেরা দিশেহারা হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ঠিকঠাক করে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরটিতে শৃঙ্খলা আনার জন্য এমন একটি বিধিমালা খুবই জরুরি বলেও তারা মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহামলার প্রতিবাদে আজ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের ডাক
পরবর্তী নিবন্ধঢাবিতে সংঘর্ষ, আহত তিনশ