গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। দৈনিক বাংলা মোড়ে শ্রম ভবনের ছয় তলায় ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। এর আধা ঘণ্টা আগে আদালতে হাজির হন নোবেলজয়ী ইউনূস। এদিন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান এবং সৈয়দ হায়দার আলী শুনানি যুক্তি উপস্থাপন করেন। সাড়ে ৩ ঘণ্টা শুনানি শেষে বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা আসামিপক্ষের যুক্তি শোনার জন্য ২০ নভেম্বর তারিখ রাখেন। খবর বিডিনিউজের।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪–এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে। ইউনূস ছাড়া মামলার বাকি আসামিরা হলেন, গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। যুক্ততর্ক শুননিতে রাষ্ট্রপক্ষে খুরশীদ আলম খান বলেন, আমরা পহেলা মে তারিখে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালন করে শ্রম আইনের নানা রকম পোস্টমর্টেম করি। কিন্তু শ্রম আইন মানি না। শ্রমিকের ছুটি ও তার নিয়োগ বিষয়ে আইন মানি না।
এ আইনজীবী চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি শ্রম আইনের বিভিন্ন বিধান, মজুরি পরিশোধ আইন, কল কারখানা আইন, আইনে শ্রমিকদের নিয়োগ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শর্ত, স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগের শর্ত, মর্যাদা, এসব ক্ষেত্রে শ্রম আইনের সঙ্গে কোম্পানি আইনের পার্থক্য নিয়ে বলেন।
কোম্পানি আইনে পরিচালকের দায়িত্ব কী, তারা মুনাফার লভ্যাংশ পান কিনা, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের কোনো কল্যাণ ফাউন্ডেশন লভ্যাংশ পায় কিনা, কত হারে পায়… ইত্যাদি বিষয়েও আইনের ব্যাখ্যা তিনি তুলে ধরেন। খুরশীদ আলম খান জেরার বিভিন্ন বিষয়বস্তু, যেমন মামলা দায়েরের উপযুক্ত ব্যক্তি, বাদীর এখতিয়ার, কোন আদালতে কে মামলা করতে পারবেন, শ্রমিকদের হাজিরা খাতা, রেজিস্ট্রার মেনটেইনেন্স, নথিপত্র সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে আসামিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেন। তিনি বলেন, কলকারখানা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পরিদর্শন করে গ্রামীণ টেলিকমে ‘শ্রম আইন লংঘন’ দেখেছেন।
এ সময় বেগুনি রঙের গ্রামীণ চেক ফতুয়া গায়ে এজলাসের দ্বিতীয় সারিতে বসে চোখ বুজে রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শুনছিলেন ইউনূস। শুনানির এক পর্যায়ে আইনজীবী খুরশীদ একই আদালতের একই রকমের অন্য একটি মামলার রায় পড়ে শোনাতে গেলে বিচারক বাধা দিয়ে বলেন, এসব তো নজির হিসাবে আনতে পারবেন না। এটা তো উচ্চ আদালতের নয়, বরং আমার আদালতের রায়। এর উত্তরে খুরশীদ বলেন, এটা ইয়োর অনার কোনো নজীর নয়, এটা একজাম্পল মাত্র। শুনানির এ পর্যায়ে আইনজীবী হাই কোর্ট এবং আপিল বিভাগে গিয়ে অভিযুক্তরা কী কী যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, যেসব আলোচনা করতে থাকলে ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এটা ট্রায়াল কোর্ট, মামলার ট্রায়াল নিয়ে কথা বলুন। উচ্চ আদালতের নির্দেশেই এখানে ট্রায়াল চলছে।
খুরশীদ আলম খান বলেন, তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছেন– এ মামলা তামাদি। কিন্তু ফৌজদারি অভিযোগ কখনও তামাদি হয় না। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বিকালে রাষ্ট্রপক্ষের অপর আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী শুনানি করেন। এরপর বিচারক ২০ নভেম্বর পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। মামলার বিচার পদ্ধতি অনুযায়ী যুক্তিতর্কের পরই রায় দেওয়া হয়। আদালতের কর্মচারীরা জানান, এ মাসের শেষ বা ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আলোচিত এ মামলার রায় হতে পরে। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ হায়দার আলী বলেছেন, রায় কবে হবে তা বলা ‘মুশকিল’।
গত ৯ নভেম্বর এ আদালতে হাজির হয়ে ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হাসান এবং দুই পরিচালক নুরজাহান বেগম ও মো. শাহজাহান আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ইউনূস সেদিন বলেন, আমি তো নিজে এ প্রতিষ্ঠানের মালিক নই। আমার আদর্শ কর্মসূচিতে কোনো ত্রুটি ছিল না। এত বড় কাজ করতে গেলে কিছু ভুল হতে পারে। আমরা তো ফেরেশতা নই। কিন্তু ভুল হলে তা ইচ্ছাকৃত নয়।
লিখিত বক্তব্যে আসামিরা ওই দিন বলেন, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকসহ ৫০টির অধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইউনূস গড়ে তুলেছেন। কোনো কোম্পানিতে তার নিজস্ব কোনো শেয়ার নেই। সুতরাং কোনো লভ্যাংশ বা লাভের টাকা কারও পকেটে ঢোকে না। কোম্পানি আইনসহ বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যাসহ এই মামলাটি কেন চলতে পারে না, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বক্তব্যে। সেখানে মামলার আসামিদের অব্যাহতির প্রার্থনা জানানো হয়।
মামলাটিতে এরই মধ্যে চারজনের সাক্ষ্য ও জেরা শেষ হয়েছে। গত ১১ অক্টোবর মামলার বাদী এবং প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে গত ৬ নভেম্বর চতুর্থ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া শেষ হয়েছে বলে জানান ইউনূসের আইনজীবী মামুন।