নিবন্ধনহীন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে, তার প্রশংসায় আছেন সাধারণ মানুষ। কেননা, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আমরা দেখি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক। ক্ষেত্রবিশেষে লাইসেন্স ছাড়াই দিনের পর দিন কার্যক্রম চলছে এসব প্রতিষ্ঠানে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা ইতোপূর্বে নেওয়া হয়নি। এমনকি প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও কেবল মুনাফার লোভে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে এসব নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। আর তাদের এই অনিয়ম ও অজ্ঞতার শিকার হয়ে অকালে ঝরে পড়ছে বহু জীবন। হাসপাতালের নামে এসব প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে কসাইখানা। যতক্ষণ না বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, এসব নজরে আসে না। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের স্বাস্থ্যসেবার মান দিনে দিনে করুণ হওয়ার কারণে চিকিৎসার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের মানুষ। দেশের অর্থনীতিও এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ধীরে ধীরে তা আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে। তাই দেশের জনগণের চিকিৎসাসেবার অধিকার নিশ্চিত করতে এই খাতে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি সরকারের আরো কঠোর অবস্থানে যাওয়ার সময় এসেছে।
নিবন্ধনহীন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) সভাপতিত্বে এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এতে বলা হয়, যেসব ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিকের লাইসেন্স নেই, তিন দিনের মধ্যে সেগুলো বন্ধ করা না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জেলা সিভিল সার্জন ও বিভাগীয় পরিচালকদের বলা হয়েছে। এছাড়া নিবন্ধন নবায়ন না করা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নবায়নের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে সংশ্লিষ্টদের বলা হয়েছে। সভায় অস্ত্রোপচারের সময় অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার কাজে এবং অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) অনিবন্ধিত চিকিৎসক রাখা হলে স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রসহ জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু করোনাভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার চিত্রটি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির খবর যেন এই খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে। ২০২০ সালের বৈশ্বিক দুর্নীতির সূচকে দুই ধাপ নিচে নেমে বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১২তম আর এই অবনমনের পেছনে করোনাভাইরাস মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতিকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। টিআইবি বলেছে, আমূল সংস্কারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম–দুর্নীতিতে জড়িতদের সঠিক শাস্তি না হওয়ার কারণেই এই খাত দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনিয়ম দুর্নীতিকে কখনো প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বহুদিন ধরে স্বাস্থ্য খাতে যে অনিয়ম চলে আসছে সেটি দূর করে স্বাস্থ্য খাতের উপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহর ভিত্তিক বড় বড় হাসপাতালগুলোতেই কেবল নজরদারি বাড়ানো হলে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে এ খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, দুর্নীতি রোধে কয়েক দফা সুপারিশ করা হলেও এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয় নি। তাঁরা মনে করেন, বহুদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতে যে অনিয়ম চলে আসছে, সেটি দূর করে স্বাস্থ্যসেবায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় চিকিৎসাসেবায় দেশ বেশ সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিন্তু সত্যি বলতে তা দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি সেভাবে। ক্যানসার, কিডনি, লিভার প্রতিস্থাপনের মতো জটিল সব রোগের চিকিৎসা এখন দেশেই সম্ভব। তবে হতাশাজনক ব্যাপার হলো, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় মানুষের ভরসা শূন্যের কোটায় বিধায় আর্থিকভাবে সচ্ছল ও সচেতন বেশির ভাগ মানুষ চিকিৎসা নেন দেশের বাইরে। তাই চিকিৎসাসেবায় সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।