‘আমি নিয়মিত ক্রিকেট খেলি। আর নাটকের দলে কাজ করি। পড়ালেখার পাশাপাশি এই দুটোই ছিল আমার নেশা। তাই দেখে একদিন বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক কামাল উদ্দীন নীলু আমায় ডেকে বললেন, একসাথে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা যায় না। একটা বেছে নাও। আমি জেদ নিয়ে বললাম, আমি দুই নৌকায় পা দিয়ে ঠিকই চলতে পারবো। সেই জেদ নিয়েই আমি অনেক বছর ক্রিকেট খেলেছি। নাটকে অভিনয় করেছি। নাটকের সাথে এখনো যুক্ত আছি।’… আলাপচারিতায় আকবর রেজা জানাচ্ছিলেন তাঁর কথা।
গ্রুপ থিয়েটার মঞ্চে দাপটের সাথে অভিনয় করা এক নিবিষ্ট নাট্যকর্মী – আকবর রেজা। সেই ১৯৭৬ সালে অরিন্দম প্রতিষ্ঠাতা সদরুল পাশার হাত ধরে নাটকের ভুবনে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালের কোন এক সময়ে অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের নাটক ‘যামিনীর শেষ সংলাপ’ দেখে সদরুল পাশার অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে আকবর রেজা সিদ্ধান্ত নিলেন, নাটকে অভিনয় করতেই হবে। সেই শুরু। বাকীটুকু ইতিহাস। ইতিহাস বললাম এই কারণে যে, একজন আপাদমস্তক ক্রিকেট খেলোয়াড় যিনি, চট্টগ্রাম জেলা ক্রিকেট দলের হয়ে খেলছেন কৃতিত্বের সাথে। আবার তবে তিনিই মঞ্চে সংলাপ বলছেন: ‘আমি তাগোরে কইলাম, আছরের সময় জোহরের নামাজ পড়াও। কেন?…. তখন তারা দীর্ঘ দীর্ঘ ছয় কদম ফেইলা– তার সাথে যখন দুই লাঠি যোগ কইরা ছায়ার নাঙল পাইলা না– তখন কইলো, তর্ক যখন শুরু হইছিল, ছায়া নাঙলের মধ্যে আছিল। তখন আমি হাসলাম। কইলাম, ক্যান তোমাগো ঐ পীর ধইরা রাখতে পারলো ঐ সুরুজটারে?’ সেই ‘লালসালু’ নাটকের মজিদ চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া আকবর রেজাকে মাঠের সাথে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে তিনি হয়ে উঠেন সর্বাধিক পরিচিত।
অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের একটি সফল প্রযোজনা ‘লালসালু’। এই নাটকের মজিদ চরিত্রটি বেশ চ্যালেঞ্জিং। কেমনে সাহস করলেন আকবর ভাই এই চরিত্র করতে… এমন প্রশ্ন করলে, আকবর রেজা বললেন, ‘লালসালু উপন্যাসটি আমি তিনবার পড়েছি। প্রত্যেক চরিত্রকে গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। পরে মজিদ চরিত্রকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। একজন মৌলভীর আচার–আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে। তারপর নিজের মত করে অভিনয় করেছি। পরে তো চট্টগ্রাম, ঢাকা, কোলকাতার দর্শকরা ভালোই বলেছে।’ হ্যাঁ, এই মজিদ চরিত্রটির সাথে এতটাই সুন্দরভাবে অভিযোজিত হয়ে গেছেন যে, এখনো মজিদ ভাবতে গেলে আকবর রেজা। আবার আকবর রেজাই মজিদ। এই এক এমন দ্বন্দ্ব তৈরি করে ফেললেন অনেকটা নিজের অজান্তেই। তাই তো একবার ঢাকায় নাগরিক নাট্যোৎসবে লালসালু নাটক দেখে হুমায়ুন ফরিদী আকবর রেজাকে বললেন, ‘লালসালু সিনেমা হচ্ছে। আমি মজিদ করছি। শ্যুটিংয়ের সময় তুই আমার সাথে থাকিস। একজন মৌলভীর সত্যিকার যে আচার–আচরণ ও তোর যে পর্যবেক্ষণ, তা আমিও পারবো না। তুই আমাকে সাহায্য করিস’। হুমায়ুন ফরিদীর এমন কথা আকবর রেজাকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমন অভিনয়ের প্রতি আরো একাত্ম হওয়ার ক্ষেত্রে করেছে অনুপ্রাণিত।
এই যে মজিদ চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি পাওয়া আকবর রেজার কাছে জানতে চাইলাম, সদরুল পাশার সান্নিধ্য বা শুরুর দিকের কথা। আকবর ভাই এবার স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন। ‘বাওয়া স্কুলের মাঠে এক মীনাবাজারে ঘোষণা দিচ্ছি বিভিন্ন স্বরে। পাশের স্টলটি ছিল অরিন্দমের। সেখানে সদরুল ভাই বসেছিলেন। পরে নমি ভাইকে ( খালেদ নোমান নমি) দিয়ে খবর পাঠালেন, চট্টগ্রাম কলেজের অডিটোরিয়ামে দলের মহড়ায় যেতে। “সেই শুরু। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি। প্যারেড মাঠে ক্রিকেট খেলে দলের মহড়ায় যাই। বেশ অনেক মাস আমার কাজ ছিল সবাইকে চা এনে চা খাওয়ানো। পরে জুটলো ‘ভোলা ময়নার বায়োস্কোপ’ নাটকে দুই তিন মিনিটের চরিত্র। শ্রমিক নেতার চরিত্র। পরে ‘রাইফেল’ নাটকের পাঁচ–ছয় মিনিটের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৭৭ সালে ঢাকার বইমেলায় মঞ্চ নাটক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিল অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়। সেখানে ‘ফলাফল নিম্নচাপ’ নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। উল্কা ট্রেনে ঢাকা যাচ্ছিলাম। আর যেতে যেতে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ স্যার আমাকে সংলাপ শিখিয়ে দিলেন। আমিও মুখস্থ করে নিলাম। এটাও আমার জীবনের বড় প্রাপ্তি।”
এভাবেই এগিয়ে চলা অভিনেতা আকবর রেজার। যদিওবা চলছিল ক্রিকেট খেলা। কোন সমস্যা হয়নি। কখনো অধ্যাপক জিয়া হায়দার, কখনো শিশির দত্ত, কখনো কামাল উদ্দন নীলুর মত নির্দেশকের সাথে কাজ করেছেন। এঁদের নির্দেশিত নাটকে অভিনেতা আকবর রেজার পরিমিত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ের আরেক সফল প্রযোজনা ‘পাপপুণ্য’। এখানে আকবর ভাই অভিনয় করলেন ‘নিতাই’ চরিত্রে। এ আরেক ভিন্ন চরিত্র। মজিদ থেকে বেরিয়ে নিতাই। ‘পাপপুণ্য’ নাটক যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের কি মনে পড়ে নিতাইয়ের সেই সংলাপ,
‘বেঁইচে রইয়েচে। এহনো বেঁচে রইয়েচে। শুয়োরের বাচ্চা আমারে স্পষ্ট ডাইকলে, বইললে– বাপ– হে! বইললো: কোদালের লোহার আমার লাগতিছে। পিঁড়ির চিপায় আমার নাগতিছে।’ আমার এখনও মনে পড়ে নিতাইয়ের এমন সংলাপে সামনে বসা দর্শক – অজান্তেই ‘ইশ ইশ ইশ’ শব্দ করে উঠে। একেবারেই ভিন্ন ধরনের। ভিন্ন স্বাদের চরিত্র নিতাই। আবারও আলোচিত হলেন নিতাই চরিত্রে অভিনেতা আকবর রেজা। মজিদ, নিতাই – দুটিই তাঁকে মঞ্চে শক্ত ভিত গড়ে দেয়।
এরপর সৈয়দ শামসুল হকের রচনায় শিশির দত্তের নির্দেশনায় ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ নাটকে নজরুল চরিত্র। একেবারেই গোবেচারা সাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা এই নাটকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মনে করে পাক সেনারা ধরে আনে নিরীহ মানুষ অন্য এক নজরুল নামের ব্যক্তিকে। নির্যাতন চলে। পরে হত্যা। যে মানুষটি মজিদ, নিতাই করলো , তিনি এবার নজরুল রূপে সাধারণ চরিত্র। এই নাটকটিও দর্শক সমাদৃত হয়েছিল। এবং আকবর রেজার অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল।
সাধারণ নজরুলের চরিত্রের পর অভিনয় করলেন আকবর রেজা ‘সাজনমেঘ’ নাটকে– এটিও অরিন্দমের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক। এক পাক বাহিনীর মেজরের চরিত্রে। ঘটনাক্রমে আমিও এই নাটকে গ্রামবাসীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। ফলে মজিদ, নিতাই, নজরুল ও মেজর – এই চারটি চরিত্র আমার কাছে একেবারেই ভিন্ন অভিজ্ঞতা এনে দেয়। কখনো দর্শক হিসেবে, আবার কখনো অভিনেতা হিসেবে।
চট্টগ্রামের নাট্য মঞ্চে দুইজন অভিনেতার অভিনয়ের নিজস্বতা ছিলো। একজন হলেন সদরুল পাশা। অন্যজন জাকারিয়া মামুন। তাঁরা টাইপড হয়ে যাননি। দর্শক উপভোগ করেছেন তাঁদের অভিনয়। সদরুল পাশা ও জাকারিয়া মামুনের চেষ্টা ছিল অভিনয়ে নতুনত্ব আনা। নিজেদের গড়েছেন চরিত্রানুযায়ী। তাঁদের উত্তরসুরী আকবর রেজাও নিজস্বতা নিয়ে অভিনয় করেছেন। ফলে আজও তাঁর অভিনীত চারটি চরিত্র মনে পড়ে। এই মনে পড়ে যাওয়াতেই আকবর রেজার অভিনয়ের সার্থকতা। একজন অভিনেতা একশত নাটক করতে পারেন। মনে রাখার মত চরিত্র পাঁচটা হলেই তিনি সফল। তাই ১৯৭৭ সালে অরিন্দম নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেয়া আকবর রেজার নাট্যজীবনে আমার কাছে মনে হয়েছে –মজিদ
(লালসালু), নিতাই ( পাপপুণ্য), নজরুল ( তোরা সব জয়ধ্বনি কর), মেজর ( সাজনমেঘ) – চারটি চরিত্রই বৈচিত্র্যময় ও ভিন্ন মাত্রার। তাই পূর্বসুরী সদরুল পাশা কিংবা জাকারিয়া মামুনকে স্মরণ করতেই হয় আকবর রেজার অভিনয় প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে। প্রসঙ্গত: একজন অভিনেতা তৈরি হয় মূলতঃ ভিন্ন ধারার চরিত্রানুগ চরিত্র প্রকাশের ভেতর থেকেই। অরিন্দমের ভিন্নধর্মী নাট্য প্রযোজনা আকবর রেজাকে ধারাবাহিকতা এবং বৈচিত্র্যমুখী চরিত্র সহায়তা করে। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় এই নাটক সমূহের অধিকাংশ নাটকের নির্দেশক ছিলেন শিশির দত্ত।
নাটকের উপর বিভিন্ন কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছেন আকবর রেজা। বরেণ্য নাট্য নির্দেশকের সাথে কাজ করেছেন। নিজেকে অভিনয় শিল্পী হিসেবে গড়তে চেয়েছেন। গড়েছেনও। তবে সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হলো তিনি কিন্তু কারো দ্বারা প্রভাবিত হননি। হতে পারেননি। হওয়ার চেষ্টাও করেননি। এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন: ‘আমি নাটকের তাত্ত্বিক বই পড়েছি। আমি নাটক পড়েছি। চরিত্রকে বোঝার চেষ্টা করে, চরিত্রানুযায়ী অভিনয় করেছি। এতে দর্শক খুশী হলেই আমার তৃপ্তি।’
এটাই একজন দক্ষ অভিনেতার অন্যতম শক্তি। ৪৬ বছর ধরে আকবর রেজা চট্টগ্রামের মঞ্চ নাটকে অভিনয় শিল্পী হিসেবে নাট্যাঙ্গনে অন্যরকম অনুভূতি জাগাতে পেরেছেন। এখনো ভাবতে থাকি মজিদ, নিতাই, নজরুল কিংবা নৃশংস মেজর।
দীর্ঘ বছর ধরে নাটকের সাথে যুক্ত থাকাটাও কম নয়। কয়েকটি প্রজন্মকে দেখেছেন তিনি। জানতে চাইলাম তাঁর কাছে, বর্তমান নাটক ও নাট্যকর্মী বিষয়ে। আকবর রেজা জানালেন: ‘এখনকার প্রজন্মের মধ্যে অস্থিরতা আছে। সবকিছুই তাড়াতাড়ি করতে চায়। শেখার আগ্রহ থাকলেও তা দীর্ঘমেয়াদী নয়। আমরা অনেকটা সময় নাটকের প্রাথমিক কাজগুলি করেছি। মঞ্চে পর্দা টাঙানোর কাজ করেছি। মেকআপ ও সেট ডিজাইন নিয়ে কাজ করেছি। এগুলো নিয়ে এখনকার প্রজন্মের আগ্রহটা কম। তাই এটা আমাকে ভাবায়। নতুন করে নাটককে ভাবতে হবে।’