৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের মানুষ খুব বেশি স্বস্তিতে নেই। চারদিকে কেমন একটা অস্থিরতা। এই অস্থিরতার মাঝে একটা শান্তির উপলক্ষই যেন খুঁজছিল দেশের মানুষ। ঠিক এমন মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এনে দিল দারুণ স্বস্তির এক উপলক্ষ। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথমবারের মত টেস্ট জয় করে আগেই একটি ইতিহাস রচনা করেছিল টিম টাইগার। বাকি ছিল আরো একটি ইতিহাস রচনার। যে ইতিহাস আগে কখনোই রচিত হয়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটে। টেস্ট ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডসহ অনেক দলকে হারিয়েছে কিংবা সিরিজ জিতেছে। কিন্তু এবারে পাকিস্তানের বিপক্ষে তাদের মাটিতে যা করে দেখাল শান্তরা সেটা অনন্য এবং অসাধারণ। পাকিস্তানের বিপক্ষে যেকোনো ফরম্যাটের একটি জয়ই তো স্বপ্নের মত। সেখানে এবার টেস্ট ক্রিকেটেই তো ২–০ তে সিরিজ জিতে তাদের হোয়াইটওয়াশ করে ছাড়ল টাইগাররা।
আর এমন একটা সময়ে নাজমুল হোসেন শান্তর দল পাকিস্তান সফরে গিয়েছিল যখন দেশের অবস্থা একেবারেই নাজুক। ঠিকমত অনুশীলন করতে পারেনি। যেকারণে বেশ আগেভাগেই যেতে হয়েছে পাকিস্তানে। দেশে পরিবার, পরিজনের জন্য ছিল দুশ্চিন্তা। সে সাথে ছিল কঠিন এই সময়ে দেশের মানুষের স্বস্তির জন্য কিছু একটা করা। ক্রিকেটাররা সেটা করতে পেরেছে রাওয়ালাপিন্ডিতে প্রথম টেস্টেই। টানা ১৩ ম্যাচে হারের পর ১৪ তম ম্যাচে এসে টেস্টে পাকিস্তানকে হারের স্বাদ দিল বাংলাদেশ। তাও যেনতেন হার নয়। একেবারে ১০ উইকেটের লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হলো পাকিস্তানকে। এরপর সেই রাওয়ালাপিন্ডিতেই সিরিজের দ্বিতীয় এবং শেষ টেস্ট। প্রথম টেস্ট জিতে টাইগাররা এতটাই উজ্জীবিত ছিল যে স্বাগতিক পাকিস্তানকে দাঁড়াতেই দিল না। ইতিহাসের হাতছানিটা দিচ্ছিল ম্যাচের চতুর্থ দিনেই। যদিও হিসেব করলে ম্যাচের তৃতীয় দিন সেটি। কারণ প্রথম দিনটা ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে। চতুর্থ দিনের শেষ সেশনটাও কেড়ে নেয় আলোক স্বল্পতা। তাই ম্যাচের শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় টাইগারদের। আর গতকাল শেষ দিনে পাকিস্তানকে ৬ উইকেটে হারিয়ে পাকিস্তানকে পাকিস্তানের মাটিতে হোয়াইট ওয়াশের পাশাপাশি প্রথমবারের মত টেস্ট, সিরিজসহ অনেক কিছুই জিতল বাংলাদেশ। আর এই সিরিজ জয়টা বিদেশের মাটিতে স্বাগতিকদের পূর্ণ শক্তির কোনো দলের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়।
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদের মাটিতে হোয়াইট ওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। তবে সে দলটি ছিল ক্যারিবীয়ানদের দ্বিতীয় সারির দল। সে সময় বোর্ডের সাথে চুক্তি নিয়ে ধর্মঘট করেছিল মূল ক্রিকেটাররা। সে হিসেবে এটিই বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে নতুন ইতিহাস।
লিটন দাশ, মুশফিকুর রহিম, সাদমান ইসলাম, মোমিনুল হক, মেহেদী হাসান মিরাজদের দুর্দান্ত ব্যাটিং। হাসান মাহমুদ, মেহেদী হাসান মিরাজ, নাহিদ রানা, তাসকিন আহমেদ এবং সাকিব আল হাসানদের বোলিং, পাশাপাশি দুর্দান্ত ফিল্ডিং বাংলাদেশের এই ইতিহাস রচনায় দারুণ ভূমিকা পালন করে। আগের দিন জয়ের জন্য ১৮৫ রান তাড়া করতে নেমে বিনা উইকেটে ৪২ রান তুলে নিয়েছিল জাকির এবং সাদমান। শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ১৪৩ রান। এই ম্যাচ জিততে কোনো তাড়াহুড়ো করেনি বাংলাদেশ। কারণ তার কোন প্রয়োজনই ছিল না। ম্যাচ সবসময়ই ছিল নিয়ন্ত্রণে। রান তাড়ায় কখনও মনে হয়নি বাংলাদেশ হারতে পারে। পঞ্চম দিনের দিনের শুরুতে পাকিস্তানি পেসারদের বোলিং ছিল বেশ আঁটসাঁট। সকাল থেকে দারুণ বোলিং করতে থাকা মির হামজা পাকিস্তানকে এনে দেন প্রথম সাফল্য। তার দুর্দান্ত ডেলিভারি জাকির হাসানের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে ছোবল দেয় স্টাম্পে। আগের দিন ২৩ বলে ৩১ রান করা ওপেনার আউট হন ৩৯ বলে ৪০ রান করে। একটু পর হামজার বলেই জীবন পান সাদমান। স্লিপে কঠিন ক্যাচ তালুবন্দি করতে পারেননি সালমান আলি আঘা। তবে পরের ওভারেই ফাঁদে পা দেন এই ওপেনার। বারবার তাকে ড্রাইভ করতে প্রলুব্ধ করছিলেন পাকিস্তানি বোলাররা। আর সে ড্রাইভ করতে গিয়েই মিড অফে সহজ ক্যাচ দেন তিনি ২৪ রান করে। এরপর কিছুটা ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করেন শান্ত এবং মোমিনুল। যদিও লাঞ্চের আগে এই জুটি পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ।
লাঞ্চের পরপর শান্তকে হারায় বাংলাদেশ। সালমানকে রিভার্স সুইপে চার মারার পরের বলে শর্ট লেগে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। ৮২ বলে করেন ৩৮ রান। কিন্তু মোমিনুল ব্যাট করছিলেন বেশ সতর্কতায়। কিন্তু হঠাৎ আবরার আহমেদকে তুলে মেরে উইকেট হারান তিনি ৭১ বলে ৩৪ রান করে। এরপর মুশফিকুর রহিম ও সাকিব আল হাসান সেই ভুল আর করেননি। দলের অভিজ্ঞতম দুই ক্রিকেটার আস্তে আস্তে দলকে নিয়ে যান কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। জয় নাগালে থাকার পরও অনেক সময় নিয়েছেন দুজন। ১২ ওভারে এ অবিচ্ছিন্ন জুটি থেকে এসেছে ৩২ রান। শেষ পর্যন্ত ইতিহাস রচনা করা জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন দলের দুই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। মুশফিক ২২ এবং সাকিব ২১ রানে অপরাজিত থাকেন।