বার্মা যাবো। এটা ভাবতেই উত্তেজনার সাথে সাথে একটা ভয়ের শিহরণ টের পাচ্ছিলাম। খুব ছোটবেলায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ফেরদৌসি মজুমদার আর হুমায়ূন ফরীদি অভিনীত নাম ভুলে যাওয়া একটা নাটক দেখেছিলাম, যেখানে হুমায়ূন ফরীদি পয়সা পুড়িয়ে ফেরদৌসি বেগমের কপালে ছেকা দিয়ে ছাপ মেরে দিয়েছিল। সেই ঘটনা নিয়ে নাটকের একটি চরিত্র রাগে ক্ষোভে প্রশ্ন করে, ‘এটা কি মগের মুল্লুক পেয়েছে?’। সংলাপটি আজও কানে গেথে আছে। প্রশ্ন করে তখন জেনেছিলাম, ‘মগের মুল্লুক’ বলতে বার্মা দেশকে বোঝায়, যে মুল্লুকে মগেরা থাকে। এরপর তো দেখতাম কোন কিছু উল্টাপাল্টা হলেই বড়রা বলত, ‘মগের মুল্লুক নাকি!’ বুঝেছিলাম যেখানে যা ইচ্ছে তা করা যায়, তাকেই বলে মগের মুল্লুক। বুদ্ধি বয়স থেকে বার্মা বলতে সবসময় দেখে এসেছি আভ্যন্তরীণ জাতিগত হানাহানি; মিলিটারির শাসন; গৃহবন্দী আং সাং সুচি; বার্মা থেকে বিতাড়িত রহিঙ্গা শরণার্থী; আফিমের লাগামছাড়া উৎপাদন; মাদক উৎপাদন এবং চোরাচালানে গোল্ডেন ট্রাইয়াঙ্গেলের মূল হোতা; মানব আর অস্ত্র চোরাচালানে সদা সক্রিয়; বনভূমি ধ্বংস করে সেগুন কাঠের ব্যবসা আর রুবি উত্তোলন; দুর্লভ সব বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তি আরও হাজারো অবৈধ এবং অনৈতিক সব কারবারের কেন্দ্রবিন্দু। সেই মগের মুল্লুকে ঘুরতে যাওয়ার আগে বেশ কয়বার ভাবতে হয় বৈকি! বার্মা ভ্রমণের সাহস করেছি একমাত্র জেবা দিদির উৎসাহে। আমার চাকুরি, স্বেচ্ছাশ্রম কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হওয়া, এমন আরও অনেককিছুর মত একা ভ্রমণের উৎসাহও পেয়েছি জেবা দিদির কাজ থেকেই। হিল্লিদিল্লি সব ও একাই ঘুরে বেড়ায়। বার্মায় পড়াশোনা করেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। ওর গল্প দুই এক কথায় শেষ হবে না। ওর কথা বলতে হবে বেশ জমিয়ে, তাই আজ তুলে রাখি। তো, ও কাছ থেকে সাহস নিয়ে বার্মা যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলাম।
বার্মায়, মানে মিয়ানমারে যাওয়ার জন্য সশরীরে ভিসার আবেদন করতে হয় না। পঞ্চাশ ডলার দিয়ে অনলাইনে টুরিস্ট ভিসার আবেদন করলাম। বিমান ভাড়া প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হলেও, থাইল্যান্ড থেকে খুব কম। মিয়ানমার ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভ্রমণকারীদের কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, এর মধ্যে অন্যতম হল- ভ্রমণকারীকে অবশ্যই কোন হোটেলে থাকতে হবে এবং পথে গাড়িতে ফ্রি লিফট নেয়া মানে হিচহাইকিং করা যাবে না। খুব সহজ কথা হল- ভ্রমণকারীকে নিজের টেকের অর্থ খরচ করেই ভ্রমণ করতে হবে, এখানে মাগনা কিছু পাওয়া যাবে না এবং এই দেশের সরকার চায় না ভ্রমণকারী বা পর্যটকেরা স্থানীয়দের সাথে মিশুক। এতে খরচ যেমন বেড়ে যাবে আবার স্থানীয়দের সাথে মেশার সুযোগ হবে না। ভ্রমণকারী নয়, পর্যটক হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। তারপরেও কাউচসারফিং ওয়েবসাইট, যেখানে ভ্রমণকারী সদস্য স্থানীয় সদস্যদের বাড়িতে বিনামূল্যে থেকে তাদের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে পারে, সেই ওয়েবসাইটে ঘেঁটে দেখলাম স্থানীয় কেউকে পাওয়া যায় কিনা। মিয়ানমারের কাউচসারফিং এর হাতে গোনা যে কয়জন সদস্য ভ্রমণকারীদের থাকতে দেয় এদের প্রায় সবাই মিয়ানমারে বিদেশি। আবার বার্মিজ নববর্ষের সময় বলে তাদের নিজেদেরও বিভিন্ন পরিকল্পনা আছে। অগত্যা হোটেল সত্যিকারের হোস্টেল বুকিং দিলাম। মিথ্যা করে হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম ভিসার আবেদনের সময়। হোস্টেল হল কম খরচে যারা ভ্রমণ করতে চায়, এবং ভ্রমণের সময় অচেনা অন্য ভ্রমণকারীদের যুক্ত হতে চায়, তাদের জন্য আদর্শ। একরুমে দোতালা খাটে চার/ ছয়/ আট/ দশ জন মানুষের থাকার ব্যবস্থা। মেয়েদের জন্য আলাদা, ছেলেদের জন্য আলাদা আবার ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্য রুমের ব্যাবস্থা আছে। আমি রেঙ্গুন শহরের কেন্দ্রে একটি হোস্টেলে মেয়েদের রুমে আট ডলারে একটি সিট বুকিং দিলাম। ভিসা, বিমানের টিকেট, হোস্টেল রুম সব প্রস্তুত, এবার কেবল উড়াল দেয়া বাকি। এক বাংলাদেশি সহকর্মীর কথা মনে শঙ্কা জাগিয়ে দিল, রহিঙ্গা বিষয়ে দুই দেশের বিদ্যমান সমস্যা এবং আমার পাসপোর্টে শরণার্থী বিষয়ক সংস্থায় কাজের ছাপ, সবমিলিয়ে মিয়ানমার বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশান কর্তৃপক্ষ আটকে দিতে পারেন। মনে সংশয় নিয়ে কোথায় কোথায় যাব কি কি করবো কোন প্ল্যান না করেই উড়াল দিলাম। ইমিগ্রেশান অফিসার জানতে চাইল মিয়ানমারে কোন আত্মীয়-স্বজন আছে আছে কীনা, জানালাম কেউ নেই। তারপর জানতে চাইল কোথায় থাকবো, হোস্টেল বুকিং-এর কাগজ দেখালাম। পাসপোর্টে ছাপ মেরে দিল ২৮ দিনের। আমি এক সপ্তাহ থাকব জানাতেই ভ্রু নাচিয়ে মুচকি হেসে বলল, ওদের খুব সুন্দর দেশে অনেক কিছু দেখার আছে। আমি যদি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে আরও কিছুদিন বেশি থাকতে চাই, তাই একটু বেশি দিনের ভিসা দিয়ে দিল।
বিমান বন্দর থেকে ট্যাক্সি নিয়ে রেঙ্গুন শহরে ঢুকতে ঢুকতে ভাবছিলাম এই শহরের সাথে চট্টগ্রামের মানুষের হাজার বছরের সম্পর্ক। ‘বানুরে ও বানু রেঙ্গুন শহর যাইয়্যুম অ্যাঁই, তোঁয়ারলাই আইন্যুম কী?’ চট্টগ্রামের প্রখ্যাত লোকগীতির শিল্পী প্রয়াত শেফালী ঘোষ এবং শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের এই গানের মাধ্যমে শৈশবে প্রথম জানি রেঙ্গুন নামক শহরের কথা। প্রতিবেশী নানীর কাছে জেনেছিলাম ওনার বাবা ব্যবসা করতেন রেঙ্গুনে। ওনার শৈশব কেটেছে ওখানেই। প্রায় এক যুগ আগে চাকরির সুবাদে টেকনাফ থাকতে গিয়ে জেনেছিলাম, রেঙ্গুন যেন ওই অঞ্চলের মানুষের কাছে অনেকটা পাশের বাড়ির মত। রেঙ্গুনে ছেলেমেয়ের বিয়ে করানো ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। টেকনাফে আমার বাড়িওয়ালা, যিনি নিজে একটি এনজিও চালাতেন, ওনার এক মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছে রেঙ্গুনে। রেঙ্গুনের রাস্তায় থামি পরা মেয়ে আর লুঙ্গি পরা ছেলেদের দেখে মনে হল মিয়ানমারের পটভূমিতে তৈরি সিনেমার কোন একটা দৃশ্যে ঢুকে পড়েছি।
আমি যে হোস্টেলে উঠেছি, সেটি বিখ্যাত সুলে প্যাগোডা থেকে দু’কদম দূরে। রুমে ঢুকে দেখি পাশের সিটে আরেকজন উঠেছে। হেঙ্গারে কাপড় শুকাতে দিয়েছে রুমের ভেতর। বিছানার পাশে ছড়ানো ছিটানো জিনিস। যেভাবে ব্যাকপ্যাক বেঁধেছে, দেখেই বোঝা যায়, খুব একটা অভ্যেস নেই ব্যাগ গুছিয়ে বাঁধার। নিজের কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে ভাবতে বসলাম কি করবো আগামী এক সপ্তাহ। রেঙ্গুন শহর থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যেতে হবে। বিভিন্ন ভ্রমণকারীদের ব্লগ পড়ে এবং জেবা দিদির পরামর্শে ঠিক করলাম বাগান আর মান্দেলা নামক শহরে যাব, সময় পেলে যাব ইনলে লেক ঘুরতে। ইচ্ছে ছিল নাগাপাহাড়ের দিকে যাওয়ার কিন্তু, সেটার জন্য অনেক পারমিশানের ব্যাপার আছে। আর এখন নববর্ষ উপলক্ষে সরকারি ছুটির সময়, তাই এই পরিকল্পনা বাদ দিতে হল।
বিকেলে বের হলাম সুলে প্যাগোডা দেখতে। এই প্যাগোডাকে ধরা হয় রেঙ্গুন শহরের কেন্দ্র হিসেবে। আলেকজেন্ডার ফ্রাঁসের নামক বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স ডিভিশনের এক ইংরেজ, যিনি রেঙ্গুন শহরের পথঘাটের নকশাকার, তিনি এই প্যাগোডাকে কেন্দ্রে রেখে এই শহরের নকশা করেছিলেন। ধারণা করা হয়, এই বৌদ্ধ মন্দিরটি হল রেঙ্গুন শহরের সবচেয়ে পুরানো মন্দির যা প্রায় ২৬০০ সাল আগে স্থাপিত হয়েছিল গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায়। এমনকি সবচেয়ে বিখ্যাত শ্বেদাগন মন্দিরেরও আগে স্থাপিত হয়। বিশ্বাস প্রচলিত আছে, গৌতম বুদ্ধ দুই বার্মিজ বণিককে তার মাথার এক গাছি চুল দিয়ে বলেছিলেন এই কেশগুচ্ছ একটি মন্দির করে সেখানে সুরক্ষা করবার জন্য। বলা হয়, এই দুই বনিক ছিলেন এই অঞ্চলে গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎশিষ্য। তিনি আরও বলেছিলেন, রেঙ্গুনের কাছে একটি পাহাড়ে গৌতম বুদ্ধের আগের আরও তিন বুদ্ধের নিদর্শন রক্ষিত আছে। সেই পাহাড়ে, তাদের দেহাংশের সাথে যেন তাঁর কেশগুচ্ছকে রাখা হয়। তৎকালীন রাজা ওক্কালাপা সেই পাহাড় কেউ খুঁজে বের করার অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পান না। রাজার এই অসহায় অবস্থা দেখে, দেবরাজ ইন্দ্রের (বৌদ্ধ ধর্মে পরিচিত সাক্র নামে) খুব খারাপ লাগল। তিনি রাজাকে সাহায্য করার জন্য পাহাড়ের উপরের জঙ্গল পরিষ্কার করে দিলেন। কিন্তু, ইন্দ্রের বয়স তখন সাড়ে তিন কোটির বেশি। সব কথা তাঁর মনে থাকে না। পূর্বতন তিন বৌদ্ধের নিদর্শন পাহাড়ের ঠিক কোন জায়গায় রাখা আছে তা তিনি মনে করতে পারলেন না। অবশেষে তিনি তাঁর একজন অধীস্তন স্থানীয় প্রবীণ দেবতারূপী আত্মা সুলে’র কাছে রাজাকে পাঠালেন। তাঁরও বয়স কয়েক কোটি বছর। তিনি ঠিকমত চোখে দেখতে পারেন না, কানে শুনেন না, তবে তিনি সেই জায়গাটি চিনতেন। তাঁর দেখান জায়গা খুঁড়ে রাজার লোকেরা তিন বৌদ্ধের নিদর্শন খুঁজে পেয়েছিলেন। চার বুদ্ধের নিদর্শন সুরক্ষিত করবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, শ্বেদাগন মন্দির। সেই দেবতারূপী আত্মা সুলে যেখানে বাস করতেন, সেই স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে সুলে প্যাগোডা। এই সুলে মন্দিরের সামনেই মিয়ানমারের মানুষ সবসময় এক হয়েছে যে কোনো প্রতিবাদ, বিপ্লবের জন্য। বার্মার ইতিহাসের ৮৮৮৮ জাগরণ, যেটি হয়েছিল ১৯৮৮ এর ৮ম মাস আগস্টের ৮ তারিখ, যার মাধ্যমে একদল কেন্দ্রিক রাষ্ট্র পরিচালনাকারী বার্মা সোশ্যালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির ২৬ বছরের শাসনব্যবস্থার পতন হয়েছিল, সেই আন্দোলনও শুরু হয়েছিল এই সুলে মন্দিরের সামনেই। যদিও গণতন্ত্রের দাবিতে জনগণের আন্দোলন ছিনতাই করে নিয়ে যায় সামরিক জান্তা, শুরু হয় জান্তা শাসনামল। এই জান্তা শাসনের প্রতিবাদও শুরু হয়েছিল এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই। অং সান সুচি, এই মন্দিরের পাশে দাঁড়িয়েই গণতন্ত্রের দাবি জানিয়েছিলেন। আজ আবার ২০২১ সাল সমগ্র মিয়ানমার জুড়ে জান্তা শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, যেটি ‘বসন্ত বিপ্লব’ পরিচয় পেয়েছে, তারও সূচনা হয়েছে এই সুলে মন্দিরের কেন্দ্রেই। বার্মার মানুষ যেন চেতন বা অবচেতনে বারবার সুলের কাছে ফিরে যাচ্ছে তাদেরকে পথ প্রদর্শনের জন্য।
সন্ধ্যে নামার আগে ফিরে এলাম হোস্টেলে। একা ভ্রমণের অন্যতম নিয়ম হল নিজেকে অহেতুক বিপদে না ফেলা। অচেনা মগের মুল্লুকে এসে রাত করে বাইরে ঘোরার ঝুঁকি নিলাম না। কালকে সকালে উঠে ঘুরে দেখব রেঙ্গুন শহর।
rupsbd@gmail.com