আমদানি করার দুই মাসেরও বেশি সময় পর অবশেষে হিমালয় কন্যা ভুটানের পণ্যবোঝাই কন্টেনার গতকাল চট্টগ্রাম ছেড়েছে। গতকাল বিকেলে পণ্যগুলো ছাড় করার পর কন্টেনারটি নিয়ে একটি প্রাইমমুভার ভুটানের পথে যাত্রা করেছে। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের (ট্রানজিট) প্রথম পরীক্ষামূলক কার্যক্রম বা ট্রায়াল রানের এসব পণ্য চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে ভারতের ভূমি ব্যবহার করে ভুটান যাবে। এতে ৬৮৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। বছরের পর বছর ধরে কলকাতা বন্দরের উপর নির্ভরশীল ভুটান একক নির্ভরতা কমাতেই মূলতঃ চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। সূত্র জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয়কন্যা ভুটান স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও নিজেদের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে এখনো অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটির কোনো সমুদ্রবন্দর নেই, এমনকি নৌবন্দর গড়ার মতো নদীপথও নেই।
ভুটানের দীর্ঘদিনের প্রধান এবং একমাত্র আন্তর্জাতিক রুট ছিল ভারতের ভূমি ও সমুদ্রবন্দর। দেশটির অভ্যন্তরীণ কয়েকটি ড্রাই পোর্ট, ফুয়েন্শোলিং, গিলেফু, সামদ্রুপ জংখার ও সামতসে থেকে পণ্য সড়কপথে আসে ভারতের ভূখণ্ডে, সেখান থেকে আবার ট্রাক ও রেলযোগে পৌঁছায় কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরে। কলকাতা সমুদ্রবন্দরই ভুটানের আমদানি–রপ্তানির প্রধান গেটওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। এই রুটে ভুটান মূলত জ্বালানি তেল, মেশিনারি, বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, নির্মাণসামগ্রীসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানি করে। বিপরীতে তারা জলবিদ্যুৎ, ফেরো অ্যালয়, খনিজ পাথর, কাঠ, সিমেন্ট ও কৃষিপণ্য রপ্তানি করে। ভারতীয় বন্দরের ওপর একক নির্ভরতা কমাতে ভুটান ক্রমশ ঝুঁকছে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের দিকে। ২০২৩ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য মুভমেন্ট অব ট্রাফিক–ইন–ট্রানজিট’ চুক্তি ও প্রটোকল সই হয়। গত বছরের এপ্রিলে ভুটানে অনুষ্ঠিত বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের বৈঠকে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল যে, পারস্পরিক সুবিধাজনক সময়ে দুটি ট্রায়াল রান সম্পন্ন হওয়ার পর চুক্তিটি কার্যকর হবে। চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর ভুটান চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা সমুদ্রবন্দর এবং বুড়িমারী, তামাবিলসহ একাধিক স্থলবন্দর ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। বাংলাদেশের মাধ্যমে ভুটানের পণ্য সমুদ্রপথে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য বাজারে পৌঁছাতে পারবে।
প্রায় ১০ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট দেশ ভুটানের অর্থনীতি খুব একটা বড় নয়। ২০২৩ সালে ভুটানের মোট পণ্য রপ্তানি ছিল প্রায় ৪৩৬ মিলিয়ন ডলার, আর আমদানির পরিমান ছিল প্রায় ১.২৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ শুধু পণ্য বাণিজ্যেই দেশটি প্রায় ৮৫৪ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে রয়েছে। একই বছর তারা রপ্তানি করেছে প্রায় ৫২.৯ বিলিয়ন নুলত্রুম (ভুটানের মুদ্রা) মূল্যের পণ্য এবং আমদানি করেছে প্রায় ১০৮.৪ বিলিয়ন নুলত্রুম। ফলে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্য ঘাটতি ৫৫.৫ বিলিয়ন নুলত্রুম।
ভুটানের রপ্তানি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ভারত। গত বছর তারা মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৭৮ শতাংশই করেছে ভারতে। এরপরেই আছে বাংলাদেশ, ইতালি, নেপাল ও চীনসহ কয়েকটি দেশ।
বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ পুরোপুরি কার্যকর হলে ভুটানের জন্য এটি হবে দ্বিতীয় সমুদ্রগেটওয়ে। এতে ভারতের ওপর একক নির্ভরতা কিছুটা কমবে, পরিবহন ব্যয়ও কমে আসবে। তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগও তৈরি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে বাংলাদেশও হিমালয় অঞ্চলের এই কার্বন–নেগেটিভ দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ও আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার করার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম পাবে।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগের সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তার সফরের পরই দেশটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি চালান নিয়ে বুড়িমারী স্থলবন্দর হয়ে এবং ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটানে নিয়ে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত চালানটি গত ২৪ সেপ্টেম্বর এমভি এইচ আর হিরা নামের জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। নানা আনুষ্ঠানিকতার পর গতকাল বিকেলে চালানটি খালাস করা হয়েছে। এই চালানে থাইল্যান্ড থেকে কিছু খাদ্য সামগ্রিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রয়েছে। সূত্র বলেছে, ট্রায়াল রানে বিভিন্ন বিষয়ের উপর পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং কোন সমস্যা থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করা হবে। পরবর্তীতে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো ঠিকঠাক হওয়ার পর ভুটান চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে নিয়মিত পণ্য পরিবহন করতে পারবে।
ভুটান চুক্তির অধীনে একটি যৌথ কারিগরি কমিটির চার্জ ও ফি নির্ধারণ করার কথা ছিল। তবে কমিটি গঠনের আগেই এবং চার্জ চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ভুটান ট্রায়াল রানের অনুরোধ জানায়। যেহেতু চালানটি দুই মাস আগেই চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে, তাই ‘বন্ধুত্বপূর্ণ নিদর্শন’ হিসেবে বাংলাদেশ এই ট্রায়াল পরিচালনায় রাজি হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল চালানটি ভুটানের পথে যাত্রা করেছে।
ভুটানের এই ট্রায়াল ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশ ফি ও চার্জের একটি তালিকা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, প্রতি চালানে ডকুমেন্ট প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রতি টন ২০ টাকা, নিরাপত্তা চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা, এসকর্ট ফি প্রতি কন্টেনারের জন্য কিলোমিটার প্রতি ৮৫ টাকা, প্রশাসনিক চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা এবং স্ক্যানিং ফি প্রতি কন্টেইনারে ২৫৪ টাকা। এছাড়া সড়ক টোল এবং করিডোর ব্যবহারের ফি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে দিয়েছে।












