অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতিতে একমত হামাস ও ইসরায়েল

গাজাবাসীদের মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ এই চুক্তি : ট্রাম্প

| শুক্রবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে, এমন খবরে ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজার ফিলিস্তিনিরা ও ইসরায়েলে জিম্মিদের পরিবারগুলো আনন্দ উদযাপন করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার গাজার তরুণরা ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাস্তাগুলোতে নেমে শ্লোগান দিয়ে, নেচে খবরটি উদযাপন করেছে। এমনকি ছিটমহলটির কিছু অংশে ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকলেও তারা দমে যায়নি। এই গাজায় টানা দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি বোমা হামলায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দার প্রায় সবাই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসে আনন্দরত আব্দুল মজিদ আব্দ রাব্বো রয়টার্সকে বলেন, এই যুদ্ধবিরতি জন্য, রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ। শুধু আমিই খুশি না, পুরো গাজা ভূখণ্ড খুশী। এই রক্তপাত বন্ধ হয়ে যুদ্ধবিরতি হওয়ায় সব আরব জনগণ, পুরো বিশ্ব খুশি। আমাদের পক্ষে যারা দাঁড়িয়েছেন সবাইকে ধন্যবাদ ও ভালোবাসা। খবর বিডিনিউজের।

ইসরায়েলের তেল আবিবে তথাকথিত জিম্মি চত্বরে গাজায় হামাসের হাতে বন্দি এক জিম্মির মা আইনভ জাঙ্গাউকার অত্যন্ত আনন্দিত ছিলেন। উদযাপনের লাল অগ্নিশিখার আলোতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আমি দম নিতে পারছি না, আমি দম নিতে পারছি না, আমি কী অনুভব করছি ব্যাখ্যা করতে পারবো না, এতো আনন্দ হচ্ছে। নিজের জিম্মি ছেলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওকে আমি কী বলবো? আমি কী করবো? জড়িয়ে ধরবো আর চুমু খাবো। শুধু বলবো আমি ওকে ভালোবাসি, এটাই। আর তার চোখ আমার চোখে ডুবে যাওয়া দেখবো, এটা অসাধারণ, এটাই স্বস্তি। ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় শান্তি আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথম পর্ব নিয়ে বুধবার ইসরায়েল ও হামাস সমঝোতা চুক্তি করেছে। পরিকল্পনার এই পর্বে যুদ্ধবিরতি এবং ইসরায়েলি জিম্মি ও ফিলিস্তিনি বন্দি বিনিময়ের কথা রয়েছে। এটি ঠিকঠাকমতো বাস্তবায়িত হলে গাজায় দুই বছর ধরে চলা প্রাণঘাতী যুদ্ধ অবসানের পথ খুলতে পারে। এই মুহূর্তে কেমন অনুভব করছেন, রয়টার্সের এমন প্রশ্নে সাবেক জিম্মি ওমের শেমটোভ বলেন, এটি বর্ণনার ভাষা নেই।

গাজার সীমান্ত অতিক্রম করে ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি ছিটমহলটিতে ইসরায়েলের শুরু করা ধ্বংসাত্মক হামলার দুই বছর পূর্তির মাত্র একদিন পর মিশরে দুই পক্ষের পরোক্ষ আলোচনায় এই অগ্রগতি হয়েছে। গাজায় তরুণদের একটি দল এ খবরে আন্দন উদযাপন করছিল। এক বন্ধুর কাঁধে চড়া এক তরুণ শ্লোগান দিচ্ছিল আর বাকিরা তাকে ঘিরে হাততালি দিচ্ছিল।

ছিটমহলটির লোকজন আনন্দে কাঁদছিল আর ‘আল্লাহু আকবর’ বলে শ্লোগান দিচ্ছিল। গাজা সিটি থেকে বাস্তুচ্যুত ব্যবসায়ী তামের আলবুরারি বলেন, আমি হাসি আর কান্না থামাতে পারছি না। আমরা বেঁচে গেছি, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। রয়টার্সকে এক কথোপকথন অ্যাপের মাধ্যমে তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে ফিরে যেতে আর অপেক্ষা করতে পারছি না, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও। গাজা সিটিতে ফিরতে চাই, বোমার আতঙ্ক ছাড়াই ঘুমাতে চাই, আমাদের জীবন পুনর্নির্মাণ করতে চাই।

হামাস শাসিত গাজা সরকারের গণমাধ্যম দপ্তর আনুষ্ঠানিভাবে চুক্তিটির বিস্তারিত খুঁটিনাটি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত লোকজনকে নিজ নিজ এলাকায় না ফেরার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। জনগণকে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো থেকে দূরে থাকতে বলেছে তারা। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীও গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিজ নিজ এলাকায় ফিরে না আসার জন্য সতর্ক করেছে। সামাজিক মাধ্যম এঙ এ বাহিনীটি বলেছে, এলাকাগুলো এখনও বিপজ্জনক যুদ্ধ অঞ্চল হয়ে আছে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসরায়েল ও হামাস গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে। বুধবার স্থানীয় সময় সকালে ট্রাম্প ট্রুথ সোশালে এক ঘোষণায় বলেন, এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।

চুক্তি অনুযায়ী, হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী গাজায় আটক ২০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দি এবং ২৮ জনের মরদেহ হস্তান্তর করবে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল মুক্তি দেবে ১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে, যাদের তালিকা হামাস দিয়েছে। তিন দিন ধরে মিশরের শার্ম আল শেখে কাতার, তুরস্ক, মিশর ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই পক্ষের পরোক্ষ আলোচনার পর এই চুক্তিতে রাজি হয় হামাসইসরায়েল।

ট্রাম্প বলেছেন, এটি আরব ও মুসলিম বিশ্ব, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এই যুদ্ধবিরতি যেন স্থায়ী শান্তিতে পরিণত হয়। চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণা এবং এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর বিশ্বের আরও অনেকেই তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, আমাদের প্রিয় বন্দিদের ঘরে ফিরিয়ে আনার আজ এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। তিনি ট্রাম্পের ব্যক্তিগত নেতৃত্ব ও সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেন। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নাঈম কাতারে সাংবাদিকদের বলেন, এই চুক্তি ফিলিস্তিনি জনগণের ধৈর্যের ফল। আমরা চাই আন্তর্জাতিক পক্ষগুলো গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার নিশ্চিত করুক।

ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেন, এই সমঝোতা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে এগোনোর একটি সম্ভাবনা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বলেছেন, ট্রাম্প এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখিয়েছেন। তুরস্ক ঘনিষ্ঠভাবে চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। কাতার জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধের অবসান ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ করে দিতে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তি।

সৌদি আরব আশা প্রকাশ করে বলেছে, এই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ কমাবে এবং ১৯৬৭ সালের সীমারেখা অনুযায়ী দুই রাষ্ট্রভিত্তিক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ নিয়ে ইসরায়েলহামাস মতৈক্যকে স্বাগত জানিয়েছে এবং সব পক্ষকে চুক্তির শর্ত মেনে চলতে বলেছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে একে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অগ্রগতি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এক বিবৃতিতে বলেছে, এই যুদ্ধবিরতি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ এনে দিয়েছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ এঙে লিখেছেন, এই চুক্তি গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে নিয়ে যাবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, এই যুদ্ধবিরতি গাজার জনগণের জন্য স্বস্তির খবর, তবে চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এঙে লিখেছেন, এই পদক্ষেপ টেকসই শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মাসের পর মাস দুর্ভোগের পর এই চুক্তি একটুখানি আশার আলো। তিনি সব পক্ষকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে আহ্বান জানান। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মস্কো থেকে বলেছেন, এই চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে হলেও এতে সব পক্ষের সহযোগিতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, এই চুক্তি এক আশার আলো। আট দশকের সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পর এই চক্র ভাঙার এখনই সময়। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা খবরকে স্বাগত জানাচ্ছেন এবং এটিই ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সূচনা বলে তিনি বিশ্বাস করেন। জার্মানি, কানাডা ও জাপানও একযোগে যুদ্ধবিরতি ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএবার নোয়াজিশপুরে গোলাগুলি
পরবর্তী নিবন্ধসাহিত্যে নোবেল পেলেন হাঙ্গেরির লাসলো ক্রাসনাহোরকাই