অবশেষে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড স্থাপনে তোড়জোড়

করোনা ব্লকটি ব্যবহারে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছে প্রস্তাবনা

রতন বড়ুয়া | রবিবার , ৯ জুলাই, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড স্থাপনে অবশেষে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালে মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে এ বিষয়ে বৈঠক করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে আলাদা ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। তবে আলাদা ওয়ার্ড স্থাপনে জায়গা সংকটের বিষয়টিও উঠে আসে আলোচনায়। এক পর্যায়ে হাসপাতালের নিচতলায় থাকা কোভিড ওয়ার্ডটি (করোনা ব্লক) ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহারের আলোচনা জোর গতি পায়।

আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড স্থাপনের বিষয়ে বৈঠকের তথ্য নিশ্চিত করেছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসার বিষয়ে বিকল্প দুটি উপায় আমরা বিবেচনায় রেখেছি। দুটির যে কোনো এক উপায়ে আলাদা ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে বলে আমরা আশা করছি।

বৈঠকের আলোচনা সূত্রে জানা যায়, চমেক হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে হাতেগোনা কয়েকজন করে রোগী ভর্তি থাকছে। এই কজন রোগীর জন্য পুরো ওয়ার্ডটি অন্য রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাই কোভিড পরিস্থিতি শুরুর সময়ের ন্যায় করোনা রোগীদের যদি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল বা এরকম কোনো একটি ডেডিকেটেট হাসপাতালে ভর্তি রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, তবে চমেক হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডটি ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে। এতে করে ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিশ্চিত হবে। এ নিয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের সঙ্গেও কথা বলেছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন গতকাল আজাদীকে বলেন, চমেক হাসপাতালের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি খারাপ না। তারা চানযেহেতু এখন কোভিড রোগীর সংখ্যা হাতেগোনা, তাই কোভিড রোগীদের আগের মতো একটি বা দুটি ডেডিকেটেট হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হোক। সব হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড রাখার প্রয়োজন নেই। সেটি হলে চমেক হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডটি তারা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় আলাদাভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন।

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই মশারির ভিতর থাকতে হয়। কারণ আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানোর পর ওই মশা যদি অন্য কাউকে কামড়ায় তবে তিনিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবেন। যার কারণে সাধারণ রোগীদের সাথে ডেঙ্গু আক্রান্তদের রেখে চিকিৎসা দেয়া সমীচিন নয়। এতে করে সাধারণ রোগীদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিটা বেড়ে যায়। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মশারির ভিতর না থাকলে এই ঝুঁকিটা বেশি। তাই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের আলাদাভাবে (আলাদা ওয়ার্ডে) চিকিৎসা দেয়া উচিত। তবে বেশ কয়টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু কর্নার করে চিকিৎসা দেয়া হলেও এখনো পর্যন্ত আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড হয়নি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। এ নিয়ে গত ২৭ জুন ‘চমেক হাসপাতাল : জায়গা সংকটে হচ্ছে না আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড’ শিরোনামে দৈনিক আজাদীর প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ৩ জুলাই ‘ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা দরকার/স্থান সংকটে হচ্ছে না’ শিরোনামে আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ডের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেনঅন্য সাধারণ রোগীদের আক্রান্তের ঝুঁকি কমাতে ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়াটা উচিত। এই প্রয়োজনীয়তা আমরাও অনুভব করছি। কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতা অনেক। এ মুহূর্তে আলাদা একটি ওয়ার্ড করার মতো জায়গা আমাদের নেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও জায়গা সংকটের কারণে আমরা আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড করতে পারছি না। তবে যেসব ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, ওয়ার্ডগুলোর এক পাশে ডেঙ্গু কর্নার করে রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান হাসপাতাল পরিচালক।

চমেক হাসপাতালের ৫টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে রয়েছেমেডিসিনের তিনটি (১৩, ১৪ ও ১৬ নং ওয়ার্ড) ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের দুটি ওয়ার্ড (৮ ও ৯)। এর মাঝে মেডিসিন ওয়ার্ডগুলোতে ডেঙ্গু কর্নার করে (এক পাশে রাখার ব্যবস্থা) আক্রান্তদের চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। শিশু ওয়ার্ডেও এক পাশে রেখে রোগীদের চিকিৎসার কথা বলছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।

তবে এক পাশে হলেও একই ওয়ার্ডের ভেতর হওয়ায় সাধারণ রোগীরাও থাকছেন পাশাপাশি। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সার্বক্ষণিক মশারির ভিতর থাকার কথা বলা হলেও তারা মশারির ভিতর থাকতে চান না। হাসপাতাল থেকেই মশারি সরবরাহ করা হয়ে থাকে ডেঙ্গু রোগীদের। কিন্তু গরমসহ নানা অজুহাতে ডেঙ্গু রোগীরা মশারি তুলে রাখেন এবং বেশির ভাগ সময় তারা মশারির বাইরে থাকেন বলে জানান চমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাজিব পালিত। তিনি বলেন, রোগীরা সচেতন নয়। যার কারণে বারবার বললেও তারা মশারির ভিতর থাকতে চান না। এতে করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের পাশাপাশি থাকা সাধারণ রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন।

ঝুঁকির কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর সাত্তার আজাদীকে বলেন, ঝুঁকি তো অবশ্যই আছে। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অবশ্যই মশারির ভিতর থাকা উচিত। শুধু হাসপাতালে নয়, ঘরে থাকলেও। নয়তো ঘরের অন্য সদস্যরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো কোনো মশা যাতে অন্য কাউকে কামড়াতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে মেডিসিন বিভাগের প্রধান বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের আলাদা করে চিকিৎসা দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।

সর্বশেষ ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা ওয়ার্ড স্থাপনের বিষয়ে গতকাল বৈঠক করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে আলোচনার প্রেক্ষিতে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছে একটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্য বিকল্পের কথাও বিবেচনায় রাখছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান এই দুই বিকল্পের কথা জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত বছর (২০২২ সালে) চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় মধ্য আগস্টের পর। তবে এবার জুনের আগেই এর প্রকোপ শুরু হয়েছে। দিনদিন এ প্রকোপ বেড়েই চলেছে। প্রকোপ শুরু হতেই ডেঙ্গুতে পরপর মৃত্যুর ঘটনা এবার উদ্বেগও বাড়াচ্ছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত মোট ১৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে তিন জনের মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে। আর ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে জুনে। চলতি জুলাইয়ের ৭ দিনে মৃত্যু হয়েছে আরো ৪ জনের।

মৃতের তালিকায় শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ, মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই। টানা কয়েকদিন ধরে পরপর মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে স্বাস্থ্য বিভাগকে। ডেঙ্গুতে পরপর এই মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। এভাবে নিয়মিত মৃত্যুর ঘটনা ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আভাস দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। এজন্য সকলকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন সিভিল সার্জন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডেঙ্গুতে নগরে আরও এক মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধলজ্জার হারে সিরিজও হারাল বাংলাদেশ