মেয়েটির স্বপ্ন ছিলো আকাশ ছোঁয়ার। সেই স্বপ্ন ছড়িয়ে পড়বে অন্য অনেকের মাঝে। আকাশও একদিন মেয়েটির স্বপ্নের কাছে নত হবে। কিন্তু হঠাৎ ওর অসহায় আত্মচিৎকার সমস্ত স্বপ্নকে মাটি চাপা দিলো। স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেলো! স্বপ্নবাজ মেয়েটি একদিন খুঁজে নিলো আত্মহননের পথ। সেই আত্মহননের মধ্য দিয়েই সমাপ্তি ঘটলো একটা প্রাণবন্ত তারুণ্যের, একটা চব্বিশ বছরের উচ্ছ্বল জীবনের! মেয়েটি লিখেছিল, ‘আমার ওপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনও সলিউশন না, কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেছে না। বিশ্বাস করেন আমি ফাইটার মানুষ’।
মেয়েটির নাম অবন্তিকা। সে লিখেছে এই সুইসাইড নোটটি। সে আরও লিখেছে এটা সুইসাইড না, এটা একটা মার্ডার, ট্যাকনিকেলই মার্ডার’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই স্ট্যাটাসটি দিয়ে আত্মহত্যা করে ফাইরুজ অবন্তিকা নামের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী। সে আইন বিভাগে পড়াশুনা করত। হয়তো ভেবেছিল একদিন বিচারকের আসনে বসে বিচার করবে কোনও লাঞ্চিত বা নিপীড়িত নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাইতো এই ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়তে এসেছিলো।
একটা আনন্দময়, সুন্দর জীবন পাওয়ায় কথা ছিলো অবন্তিকার। বন্ধুবান্ধবদের সাথে হৈহুল্লোড় করে কাটানো হাসিমুখটাই হতে পারতো তার তরুণ মনের প্রশান্তি। কিন্তু অকালেই ঝরে যেতে হলো তাকে। কোনও অন্যায় দেখলে সে চুপ করে থাকতে পারতো না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই ছিলো তার স্বভাব। তাইতো একটা দুর্বিষহ, অসহায় জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিলো। আর সেই দুর্বিষহ জীবনটা যারা তাকে উপহার দিয়েছিলো তাদের একজন তার সহপাঠী আর অন্যজন তারই শিক্ষক। অনেক আশা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়তে এসেও শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারলোনা অবন্তিকা। হেরে গেলো তার জীবনের কাছে, হেরে গেলো তার স্বপ্নের কাছে।
তার পরিবার পরিজন, বন্ধুবান্ধবের ভাষ্য থেকে জানা যায় সে ছিলো যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়চেতা একজন মানুষ। অসহায় মানুষের প্রতি, শিশুদের প্রতি সে ছিলো প্রচণ্ড সহানুভূতিশীল। শুধু তাই নয় ক্যাম্পাসের কুকুর বিড়ালদের প্রতিও ছিলো তার ভীষণ মায়া। তাদের খাবার দিতো, বিপদে পড়লে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বাইরে সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজে ছিলো তার প্রচণ্ড উৎসাহ। বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও করতো বেশ দক্ষতার সাথে। কিন্তু যখনই তার সাথে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন নোংরামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা শুরু করলো তখনই তার জীবনে নেমে আসলো অমাবস্যার অন্ধকার। আসলে সমাজের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যখন কোনও মেয়ে সমাজের বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তখনই সেই মেয়েকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য, তাকে নিয়ে কুৎসা রটানোর জন্য কিছু বিকৃত মনমানসিকতার মানুষ নামের হায়ানা তৎপর হয়ে ওঠে। অবন্তিকা নামের মেয়েটিও তারই এক নোংরা, বিকৃত রুচি এবং যৌন নিপীড়ক সহপাঠী এবং শিক্ষক দ্বারা অপমানিত, লাঞ্চিত এবং বুলিংয়ের শিকার হয়ে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলো। আমাদের সমাজে এরকম অবন্তিকা কিন্তু একজন নয় আরও বহু অবন্তিকা চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস রাখে, কেউ ভয়ে মুখ খুলতে চায় না।
কোন পিতা, মাতা বা অভিভাবক যখন তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান তখন তারা এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন যে মা, বাবার পরে শিক্ষকরাই তাদের ছেলেমেয়েদের দেখে রাখবেন নিজের ছেলেমেয়ের মতো সমস্ত বিপদ আপদে তারাই ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন। শিক্ষকরা প্রয়োজনে শাসন করবেন আবার বুকেও টেনে নেবেন।
সেই শিক্ষার্থীরাই একদিন সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে আদর্শ মানুষ হবে।
অথচ ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসা থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ এমনকি দেশের ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুটিকয়েক শিক্ষক নামধারী অমানুষ তাদের ক্ষমতার দাম্ভিকতা দেখিয়ে ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করছে, অপমানিত করছে। তাদের শারীরিক, মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে তুলছে। তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ার শেষ করে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।
এরকম হাতে গোনা কিছু শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজ আজ কলঙ্কিত। এই সমস্ত শিক্ষকদের কারণে অভিভাবক শিক্ষার্থী সকলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। যার ফলে সেইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা।
একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৭০ ভাগের বেশি ছাত্রী বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভাবা যায় কী রকম এক ভয়াবহ অবস্থা! একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন মিটিং, মিছিল, বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় জনগণ। তারপর নতুন আরেকটি ঘটনা চলে আসে, পুরনো ঘটনা চাপা পড়ে যায়।
এভাবেই একসময় মানুষ ভুলে যায় নুসরাত, তনুদের মতন আরও অনেককে। ঠিক একইভাবে একসময় অবন্তিকাকেও কেউ মনে রাখবে না! ভুক্তভোগী পরিবার সুবিচারের অপেক্ষায় এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে একসময় ক্লান্ত পথিক হয়ে ঘরে ফিরে যাবে! আর বিচারের বাণী এভাবেই নীরবে নিভৃতে কেঁদে যায়।
অবন্তিকারাও নীরবে চলে যায়, রেখে যায় তাদের দীর্ঘশ্বাস। তাই সবশেষে বলবো আর কোনও অবন্তিকাকে যেন চলে যেতে না হয়। অবন্তিকাকে দিয়েই শেষ হোক নারীদের প্রতি নিপীড়ন, অবমাননা আর লাঞ্চনা।
এইসব হায়েনাদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া হোক, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক অপরাধীদের বিরুদ্ধে। অবন্তিকার পরিবার ন্যায়বিচার পাক। বুঝিয়ে দেয়া হোক অবন্তিকারা শুধু নারী হয়ে নয় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষক।