অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ভয়ংকরী, দরকার টেকসই পরিকল্পনা

ফজলুর রহমান | মঙ্গলবার , ১২ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

সাবেক জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত ড. আনিসুজ্জামান এর একটি স্মৃতিকথা শুনি। যা ২০১৬ সালে ড. রশীদ স্মারক বক্তৃতায় তিনি তুলে ধরেছিলেন। ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবিজ্ঞানবিষয়ের এক স্প্যানিশ শিক্ষিকা কথায় কথায় আমাকে একবার বলেছিলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কয়েকটি ধনী দেশের যৌথ অর্থসাহায্যে আফ্রিকার একটি দরিদ্র দেশে নদীর ওপরে একটি সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা হয় এবং তার নকশা প্রণয়ন করতে ওই শিক্ষিকার পিতাকে আহ্বান জানানো হয়। ভদ্রলোক সে দেশে গিয়ে সরেজমিনে সবকিছু দেখে এসে এই কাজের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। কেননা, তাঁর মতে, সেখানে যেধরনের সেতু নির্মাণ করতে হবে, তার রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য ওই দেশের নেই। দাতারা সেতু তৈরি করে দেবেন বটে, কিন্তু তারপর তো ওই সেতুর বিষয়ে তাঁদের কোনো দায়িত্ব থাকবে না। তখন সেতুটি সেদেশের সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। আমার কাছে ওই ঘটনাটি সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলে মনে হয়। তিনি এত কিছু না ভেবে কাজটি করে দিতে পারতেন, ফল যাদের ভোগ করার কথা, তারা তা করত। বস্তুত, প্রত্যেক উদ্ভাবন ও নির্মাণের সামাজিক প্রতিক্রিয়া আছে।’

এই স্মৃতিচারণ থেকে আমরা অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, অনুচিত খরচ সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা পেলাম। আসলে ভবিষ্যতের ভাবনা না ভেবে নেয়া কাজগুলো কোন না কোন সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাই টেকসই পরিকল্পনার বিকল্প নেই।

ধনী দেশ থেকে যেভাবে এলো দারিদ্র্যের কাতারে দ্বীপরাষ্ট্র নাওরু কীভাবে এলো তা আমরা অনেকে জানি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের পাশে অবস্থিত দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র নাওরু এক সময় ছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। মাত্র ২১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট দেশটি ১৯৭০এর দশকে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী রাষ্ট্র। অথচ আজ নাওরু আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল এক দরিদ্র রাষ্ট্র। সরকার নাগরিকদের জন্য আয়কর তুলে দেয়, বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়, চিকিৎসা খরচ ফ্রি করে দেয়। এমনকি কেউ কাজ করুক বা না করুক সরকার থেকে মাসিক ভাতা পেত। একসময়কার ‘স্বগরাজ্য’তে রূপ নেয় এই দ্বীপ।

তবে সুখের দিন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পুরো দেশটি যখন কেবল একটি খনিজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন শুরু হয় অবনমন। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অপচয়, দুর্নীতি আর ভুল বিনিয়োগ। ফলে শুধু অর্থনীতি নয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেও নাওরু বিপর্যস্ত। উচ্চমাত্রার স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশিরভাগ নাগরিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, স্থূলতার হারে বিশ্বের শীর্ষে এই দেশ। নাওরুর গল্প শুধুই ইতিহাস নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য এক সতর্ক বার্তা। প্রাকৃতিক সম্পদের নয়ছয় ও দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব একটি জাতিকে কীভাবে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে এই দ্বীপ রাষ্ট্র।

টেকসই ভবিষ্যত গড়তে এখন বলা যায় এখন সব দেশই পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে কৃচ্ছ্রসাধনে আরও কঠোর হচ্ছে। অর্থনীতিকে চাপমুক্ত করতেই ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রায় ২ দশক ধরে পৃথিবী জুড়ে চলছে ব্যয় সংকোচন নীতির প্রসার। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি ব্যয় সংকোচনের অর্থনীতি কার্যকরও হয়েছে পুরোদমে। গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশি বরাদ্দ ও ভর্তুকি দেওয়া, দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকার রাখার জন্য এসব পদক্ষেপ জরুরি। সমপ্রতি উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও এ ধরনের একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই।

চলমান বৈশ্বিক বিষয়টি সামনে রেখে ব্যয় সংকোচনে আমাদের সরকারও এরমধ্যেই বেশকিছু সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় অবধি খরচ সামলে চলার সময় এখনই। চাইলে ব্যক্তিগতভাবে এটাতে আত্ননিয়োগ করা যায়। মনে রাখা দরকার যে, এক টাকা সাশ্রয় করতে পারাটা এক টাকা আয়ের সমান।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)-এর সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর প্রয়াত অধ্যাপক ড. শ্যামল কান্তি বিশ্বাস স্যার। তিনি জাপানে থাকাকালে দেখা একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন সময়ে সময়ে। তিনি বলতেন, ‘আমি আর একজন জাপানি প্রফেসর পাশাপাশি কক্ষে থাকতাম। ওই জাপানি প্রফেসরকে দেখতাম রুম থেকে বের হওয়ার আগেই সব লাইটফ্যান বন্ধ করতেন। যতবার বের হতেন ততবার তা করতেন। সেটা ১ মিনিটের জন্য হোক, এক দিনের জন্য হোক। এমনকি আশেপাশে অপ্রয়োজনীয় লাইট থাকলে তাও বন্ধ করতেন। জাপান উন্নত দেশ। অঢেল প্রাচুর্য ওদের। তারপরও তারা কতো সাবধানী! দেশের সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে তারা কতোই না সর্তক। আমি বুঝেছি, জাপান শুধু পরিশ্রম করেই ধনী দেশ হয়নি, পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়েও বড় হয়েছে। এ ধরনের ব্যয় সাশ্রয়ী কাজ আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বেশি বেশি প্রয়োজন।’

স্যারের কথাই শতভাগ সত্য। আমাদের এগিয়ে যেতে হলে ব্যয় সাশ্রয় অপরিহার্য। অপ্রয়োজনীয় খরচ করে ফেলেলে, খরচ করার লোভ সামলাতে না পারলে মহা বিপদে পড়তে হয়। এজন্য লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞরা কিছু টিপস্‌ দিয়েছেন, যা অনুসরণ করলে আপনার অপ্রয়োজনীয় খরচ একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে পারে।

এক. বাজেটিং করা। আপনি আপনার আয় কত সেটা ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু খরচ কোন খাতে কত করবেন এটা আপনি ঠিকমত নাও জানতে পারেন। আপনি লিখে ফেলুন। এতে বুঝতে পারবেন কতটুকু আপনি দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যয় করছেন। বাজেটিং করা হচ্ছে প্রথম কাজ, যে কাজটা করলে আপনি আপনার আয় ও ব্যয়ের একটা পরিষ্কার ধারণা করতে পারেন।

দুই. নিডস এবং ওয়ান্টসের প্রতি খুবই যত্নশীল হওয়া। যেটা আপনার অতীব প্রয়োজন, যেটা না হলে আপনার চলছেই না, সেটা হচ্ছে আপনার নিডস বা চাহিদা। আর ওয়ান্টস বা ইচ্ছা হচ্ছে সেটা যা আপনার না হলে চলে কিন্তু জীবনে মূল্য সংযোজন করে। যেহেতু আপনি অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিতে চাচ্ছেন, তাই নিডসের প্রতি আপনি যত্নশীল হবেন, পাশাপাশি ওয়ান্টস এর ব্যাপারে খুবই সতর্ক হবেন।

তিন. পরিকল্পনা করা। আপনি কী কী কিনবেন এবং কোন দামের মধ্যে কিনবেন সেটা লিখবেন। এরপর যখন আপনি কিনতে যাবেন তখন শুধু ওই জিনিসটাই কিনবেন। পরিকল্পনার বাইরে কোন কিছু কিনবেন না।

চার. খরচ বা এক্সপেন্ডিচার ট্র্যাক করা। আপনি যখন কোন খরচ করবেন তখন খরচটাকে ট্র্যাক করবেন। দেখবেন যে আপনার বাজেটের সাথে যায় কিনা। যদি বাজেটের বাইরে চলে যায়, আপনি আপনার নিজের মনকে কিনতে নিষেধ করবেন।

পাঁচ. খুচরা লোভ থেকে নিজেকে দূরে রাখা। যেগুলো আপনি একদমই ব্যবহার করছেন না বা খুব কম ব্যবহার করছেন কিন্তু প্রতি মাসে টাকা দিচ্ছেন ঐগুলো আপনি বাদ দিয়ে দিন।

ছয়. তুলনা করে শপিং করুন। অনেকগুলো দোকান যাচাই করে কিনুন, আপনার ঠকার সম্ভাবনা কম থাকবে, আপনার খরচের মাত্রাটা কমে আসবে। দেখবেন, যখন আপনি কোন জিনিস তুলনা করে কিনছেন, তখন আপনি বেস্ট অফারটা নিতে পারছেন কম দামে।

সাত. নিজেই কাজটা করুন। সংসারের ছোট ছোট কাজগুলো বিশেষ কঠিন কোন কাজ না। এটা নিজে শিখে নিতে পারেন, একটু কষ্ট করলে এটা শেখা যায়। যদি এই কাজটা শেখা যায়, মাসে আপনি কয়েক হাজার টাকা খরচের হাত থেকে আপনি বাঁচতে পারেন।

আট, ক্রেডিট কার্ড পরিত্যাগ করা। ক্যাশ টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করবেন। ক্রেডিট কার্ড যত থাকবে, তত আপনার খরচ বাড়বে। ক্রেডিট কার্ড যত আপনার সহজলভ্য হবে ততই দেখবেন, আপনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আপনি আপনার ঘর ভর্তি করে ফেলছেন। নগদে কিনলে টাকার খরচের ব্যথা আপনি বুঝতে পারেন, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বা ডেবিট কার্ড দিয়ে কিনলে এই কষ্টটা বোঝা যায় বেশ পরে।

নয়. ইউটিলিটির ব্যাপারে খুব সচেতন থাকা। পানি কী পরিমাণ খরচ হচ্ছে, গ্যাস কী পরিমাণ খরচ, ইলেকট্রিসিটি কী পরিমাণ খরচ হচ্ছেএইসব ব্যাপারে আপনি নিজে সচেতন হন এবং পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে সচেতন করুন। তাহলে দেখবেন, প্রতি মাসে খরচ অনেক কমে এসেছে। মনে রাখবেন, এক টাকা খরচ কমানো মানে এক টাকা বেশি সেভ করতে পারা।

এভাবে অপ্রয়োজনীয় খরচের হাত থেকে বাঁচতে চেষ্টা করতে হবে। এতে করে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র স্বাবলম্বী হয়। ধীরে ধীরে আসে আর্থিক স্বাধীনতা।

লেখক: উপপরিচালক (জনসংযোগ), চট্টগ্রাম

প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবি মুদাসসীর আলীর দুটি অসাধারণ সৃষ্টি
পরবর্তী নিবন্ধরাঙ্গুনিয়ার কুরমাই খালে ব্লক স্থাপনের দাবি