পর্ব : ১
চট্টগ্রামের কিছু অঞ্চলে অপেশাদারী চিকিৎসা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এ সমস্ত অপচিকিৎসার কবলে পড়ে নিগৃহীত হচ্ছে অসংখ্য নিরীহ রোগী ও রোগীর স্বজনেরা। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, সচেতন শিক্ষিত সমাজ–তাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অপচিকিৎসা চলে আসলেও ভুক্তভোগীরা কোন অভিযোগ দেয় না, স্থানীয় প্রশাসন কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ কেন দেয় না, তার নিগূঢ় রহস্য আমরা অদ্যাবধি খুঁজে বের করতে পারিনি। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নন্দিরহাট ও বালুচড়া এলাকায় মাছের কাঁটা তোলার নামে অপচিকিৎসা চলছে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে। কোন একজন রোগী গলায় কাঁটা আটকে গেলে স্বজনদের পরামর্শে এ সমস্ত এলাকার মহিলা কবিরাজের কাছে যায় কাঁটা তুলতে। এরপরে যদি আবারও কাঁটা আটকে থাকার অনুভূতি লাগে আবারও যান ঐ কবিরাজের কাছে। এবারও তিনি দিব্যি কাঁটা তুলে নিয়ে রোগীর হাতে ধরিয়ে দেন। এভাবে আট/দশ বার গেলেও প্রতিবারই মাছের কাঁটা হাতে তুলে দেন ঐ প্রতারকগণ। এই কাঁটা তোলা পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয়। একজন ইএনটি বিশেষজ্ঞ হিসাবে বলতে চাই–যে কোন মাছের কাঁটা যদি গলায় আটকে যায় তবে প্রথমেই আটকাবে মুখগহব্বরের দু’দিকে অবস্থিত টনসিল নামক দুটি গ্রন্থির মধ্যে অবস্থিত crypt– এ। প্রতিটা টনসিলে ১৫–২০ টা crypt থাকে। স্বাভাবিকভাবে এই crypt গুলো তে কাঁটা প্রথমেই আটকায়। টনসিলের anterior pillar অথবা posterior pillar এ আটকে থাকার সম্ভাবনাও থাকে। এদিকে pharynx নামক মুখগহব্বরের একটি জায়গায় কাঁটা আটকে থাকার সম্ভাবনা থাকে। এর সর্বশেষ ধাপটি হচ্ছে জিহব্বার পেছন ভাগ, যেখানে কাঁটা আটকালে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে সংশ্লিষ্ট ইএনটি ডাক্তারের। indirect laryngoscopyএর guidance এ জিহব্বার পেছনভাগে বিধে থাকা কাঁটা তুলতে হয়। কাঁটা অপসারণ করতে গিয়ে ইএনটি চিকিৎসকদের অনেক সময় গলদঘর্ম হতে হয়। এত কঠিন জিনিসটাকে কিভাবে একজন অজপাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত মহিলা অপসারণ করেন নিমিষেই? এটা কি কোন জাদুকরি কিংবা অন্য কিছু? তবে আজ থেকে ১৫ বছর আগে চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাংবাদিক ইফতেখারুল ইসলাম আমার কাছ থেকে এই প্রতারণার বিবরণ শুনে বালুচড়া এলাকার সেই কাঁটা তোলা প্রতারক মহিলার কাছে গিয়েছিলেন নিজে রোগী সেজে। উনার গলা থেকে অবলীলাক্রমে কাঁটা তুলে ফেললেন মহিলাটি আর এতেই ঘটে বিপত্তি। সাংবাদিক ভাই প্রতারক মহিলাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেললেন–কিভাবে গলায় কাঁটা না বিধলেও কাঁটা অপসারণ করলেন? মহিলাটি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তখনই বের হয়ে গেল থলের বিড়াল। অনেক ভুক্তভোগী আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করে থাকেন কিন্তু তারা আইনী সংস্থার কাছে যায় না ঝুট–ঝামেলার ভয়ে। ওদিকে স্থানীয় কিছু মাস্তান প্রকৃতির লোকদের মাসোহারা দিয়ে থাকেন এই সমস্ত প্রতারকরা (যারা দীর্ঘদিন থেকে সাধারণ মানুষদের প্রতারিত করে আসছেন) তাদের এসব অপকর্ম ঢাকা দেওয়ার নিমিত্তে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অগোচরে এসব বিষয় আছে–তা আমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। এ সমস্ত প্রতারক মহিলারা কাঁটা এবং বিভিন্ন প্রাণীর হাড় গলা থেকে বের করার নামে যে অপকর্ম কিংবা অপচিকিৎসা করে আসছেন তার বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। আর এতেই তিন তলা বাড়ীসহ অনেক ধন সম্পদেরও মালিক হয়েছেন তারা। অথচ এই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় চলে আসলেও তা বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি প্রশাসন। আবার কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী রয়েছেন যারা সেখানে গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করে। এরাই এই অপচিকিৎসাকে ভালো চিকিৎসা বলে বেড়ায় গ্রামবাসী কিংবা স্বজনদের কাছে। প্রতারক মহিলাদের এই অভিনব প্রতারণা চালিয়ে যাওয়া–এটাও একটা বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। প্রতিবার ৫০০ টাকা করে হাতিয়ে নেন এই প্রতারক মহিলাগণ। ইদানিং শোনা যাচ্ছে, প্রথমদিকে দু’জন মহিলা প্রতারক থাকলেও এখন অনেক মহিলা এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। ১০ বছর ধরে পায়ের গোড়ালীতে বিঁধে থাকা গাছের গুড়িও বের করার অনন্য ইতিহাস রয়েছে এসব প্রতারক মহিলাদের! আমার ভাবতে অবাক লাগে–আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে এ সমস্ত প্রতারকরা কিভাবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে? প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তারা অবৈধ অপচিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই। দুনিয়ার কোন বিচারের সম্মুখীন হয়তো হতে হবে না এই প্রতারকদের কিন্তু হাজার হাজার নিরীহ রোগীদের সর্বস্বান্তকারী এসব ধোকাবাজ প্রতারকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে কাল কেয়ামতের কঠিন ময়দানে কারণ সে নিজে অস্বীকার করলেও তার হাত, পা এই প্রতারণার জবাব দেবে আল্লাহতায়ালার কাছে, ‘আজ আমি তাদের মুখের উপর মোহর মেরে দেবো, তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে, তাদের পাগুলো সাক্ষ্য দেবে– তারা যা কিছু অর্জন করছিল’– সূরা ইয়াসিন– ৬৫। এরপরও যে জমিনের উপর ভর করে এই অপকর্ম করেছে সে জমিনের জবান খুলে যাবে সেই কঠিন দিনে। অতএব এভাবে নিরীহ রোগীেেদর দীর্ঘ সময় প্রতারণা করার যে অভিনব কৌশল এখনও চলমান তাদেরকে আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি। সামান্য একটি ছোট্ট কাঁটাও যদি বিধে গলার মাঝে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আহাজারিতে কেঁপে উঠে ঘরময়। আর প্রচণ্ড ব্যথা ও জ্বরেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দু’মুঠো ভাত মুখে দিতেও ব্যর্থ হয় সংশ্লিষ্ট রোগীর। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বলতে চাই–তিনমাস আগের আটকে থাকা কাঁটা সেই প্রতারক মহিলাদের আস্তানায় গিয়ে অপসারণ করে আসেন কিন্তু ব্যথা দূরীভূত না হওয়ায় আমার কাছে আসেন সেই ভুক্তভোগী রোগী আর আমি টনসিলের crypt এ আটকে থাকা কাঁটাটি নিমিষেই সরিয়ে ফেলি আর এতেই প্রকাশ পায় প্রতারণার সেই অভিনব কৌশল। তৎকালীন হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি সাহেবকেও আমি এই বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, স্থানীয়রা কিংবা ভুক্তভোগীরা কেউ অভিযোগ না দিলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এটাই আমাদের আইনী সংস্থার ভাষ্য! অপচিকিৎসার নামে যদি কোনো রেজিষ্টার্ড ডাক্তার শাস্তি পেতে পারে কিংবা কারাভোগ করতে পারে, তাহলে কেন বছর বছর চলে আসা কাঁটা তোলার নামে অভিনব প্রতারণাকারী এই সমস্ত মহিলা কবিরাজদের বিরুদ্ধে আইনের ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? বালুচড়া কিংবা নন্দীরহাট এলাকায় গেলেই এদের আস্তানা খুঁেজ বের করা কোনো ব্যাপারই না। ঘটনাসূত্রে প্রকাশ, কেউ যদি গলায় মাছের কাঁটা নিয়ে এ সমস্ত প্রতারকদের কাছে আসেন তারা প্রথমেই জেনে নেন কোন মাছের কাঁটা? পরবর্তীতে তাদের কাছে বিশেষভাবে গুছিয়ে রাখা কটনের মধ্যে আগে থেকেই থাকা কাঁটা গলার মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে একটু নড়াচড়া করে নিয়ে আসে বিধে থাকা কাঁটাটি। অথচ এই কাটা সেই কাঁটা নয়। এই কাঁটা হচ্ছে আগে থেকে কটনের ভেতর থাকা বিশেষভাবে রাখা কাঁটা। এভাবে চোখে ধুলো দিয়ে প্রতারণা চলছে চট্টগ্রামের উক্ত এলাকাগুলোতে। অবিলম্বে এই প্রতারকদের আইনের আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল