অপেশাদারী চিকিৎসার হাতে নিগৃৃহীত নিরীহ রোগীসমাজ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ৪ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

পর্ব৩। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলাধীন ফতেয়াবাদ মিস্ত্রীপাড়া এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে নাকের অপচিকিৎসা চলে আসছে। যাদের নাকের হাড় বাঁকা এবং inferior turbinate hypertrophy থাকে তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয়। মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলেন, ঘুমের মধ্যে ঘোর কাটেন। যার শব্দে আশপাশের কেউ ঘুমোতে পারেন নাস্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। যারা অপারেশনকে ভয় পায় অথবা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একাংশ মিস্ত্রিপাড়ায় অবস্থিত কিছু হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। তারা এক ধরনের ক্রিম জাতীয় পদার্থ নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন আর এতেই বলা হয় নাকের অতিরিক্ত মাংসগুলো খসে পড়বে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শ্বাস নিতে আর কষ্ট হবে না, আরামবোধ করবেন। এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে হাজার হাজার রোগীকে সর্বস্বান্ত করে দিচ্ছে সে সমস্ত হাতুড়ে চিকিৎসকরা। মিস্ত্রিপাড়া এলাকার অনেকেই এই পেশার সাথে জড়িত। তারা প্রতারণার জাল বিছিয়ে নিরীহ গরীব জনসাধারণকে দীর্ঘদিন ধরে ঠকিয়ে আসছে। তারা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রোগীদেরকে motivate করার চেষ্টা করেন। যখন কাঙ্খিত ফলাফল না পায় তখন সংশ্লিষ্ট রোগীরা নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞদের কাছে চলে আসেন। এতেই বেরিয়ে আসে এই অপচিকিৎসার থলের বিড়াল। ততক্ষণে সমুদ্রের পানি অনেক গড়িয়েছে। যা হবার তাই হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রোগীর আর্তনাদ কে শুনে? নাকের মধ্যে যে পদার্থ দিয়ে তারা চিকিৎসা করিয়েছেন সেগুলো নাকের septum এর সাথে lateral wall of the nose মিশে গিয়ে পুনরায় নাক বন্ধ হয়ে কঠিন সংকটে পতিত হতে হয় হতভাগ্য রোগীকেযাকে মেডিকেল পরিভাষায় synechia বলা হয়। হতদরিদ্র কিংবা অতিবুদ্ধিমান রোগীদের নাকের সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আরও অধিক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়, জীবনযাত্রা হয় চরমভাবে ব্যাহত। হিতে বিপরীত হয়ে জীবনের অংক। অল্প টাকায় চিকিৎসা করার লোভটা সামলাতে না পেরে নিজের জীবনটাকেই চরম সংকটের দিকে ধাবিত করছে অসহায় রোগীসমগ্র। এই synechia release করতে গিয়ে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞদের চরম ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয়। adhesion হয়ে যাওয়ায় release করতে গিয়ে septal perforation হয়ে যায় এবং এতে crust জমে গিয়ে নাক আবারও বন্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘদিন ধরে crust জমা থাকলে নাক থেকে দুর্গন্ধ বের হয় এবং রোগীর জীবনে এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং তা সামাল দিতে রোগীকে হিমশিম খেতে হয়। এভাবে অজপাড়াগাঁয়ের হাতুড়ে ডাক্তারদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয় সাধারণ রোগী সমাজ। সঠিক counselling এবং motivation এর অভাবে কিছু কিছু রোগীদের জীবন হাতুড়ে ডাক্তারদের খপ্পরে পড়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠে। এর দায়ভার কে নেবে? অনেক বছর ধরে চলে আসা এই অপচিকিৎসা রোধে কার্যত কোন প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। মাজাভাঙ্গা প্রশাসন এক্ষেত্রে যেন নির্বাক, অসহায়। প্রশাসন যদি একটু নেক নজর দিতেন তাহলে অনেক অসহায় মানুষ বিপদগামী হওয়ার মুখোমুখি হওয়ার থেকে বেঁচে থাকতে পারতেন। দূর দূরান্ত থেকে এই অপচিকিৎসার গন্ধ পেয়ে ছুটে আসেন গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষেরা ফতেয়াবাদের মিস্ত্রিপাড়ায়। আর এতেই সর্বশান্ত হয়ে ফিরে যান নিজ গ্রাম অভিমুখে। শুধুমাত্র নাকের crust নয়, ক্ষেত্র বিশেষে এই অপচিকিৎসার ফলে nasal bridge fall down হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। নাক ভোঁতা ও বিশ্রী হয়ে যায়যেটাকে বলা হয় frog face deformity। পরবর্তীতে Rhinoplasty করে Correction করতে হয়যেটা অত্যন্ত জটিল। আর আমাদের দেশে Rhinoplasty সার্জন তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অতএব দেখা যায়, সামান্য একটি ভুলের কারণে সাধারণ মানুষকে কত ভোগান্তি পোহাতে হয় তা বলাই বাহুল্য। এদিকে আজকাল দেখা যায় নাক, কান ও গলা চিকিৎসার জন্য অনেকেই গ্রাম্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়। কানের সমস্যা বললেই সংশ্লিষ্ট গ্রাম্য চিকিৎসক কানের ড্রপ প্রেসক্রাইব করেন। অথচ কানের পর্দা ছিদ্র না থাকলে কিংবা পুঁজপানি না পড়লে কানের ড্রপ দেওয়ার কোন recommendation নেই। আর এতেই জটিলতা বৃদ্ধি পায়। এরকম শত শত রোগী আমরা পেয়েছি যাদের পর্দায় ছিদ্র না থাকলেও অনুমানের উপর ভিত্তি করে কানের ড্রপ দিয়ে থাকেন গ্রাম্য চিকিৎসকগণ। আর indication না থাকলেও টনসিল অপারেশন করার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকেন এবং referred করেন নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞদের কাছে। আর অতি অল্প সংখ্যক বিশেষজ্ঞরাই সেই সুযোগটি লুফে নেন। অথচ এত কম সময়ের অভিযোগের কারণে টনসিল অপারেশন করার কোন যৌক্তিকতা নেই। যা মেডিকেল Eehics এর পরিপন্থি। আজকাল মেডিকেল Ethics কয়জন মানেন? tonsillectomy অপারেশনের ক্ষেত্রে indication এর বাইরে অনেক সময় অপারেশন করা হয়যা অন্যায্য ও অন্যায়। ঘন ঘন গলা ব্যথা বৎসরে যদি ৬ বারের বেশি হয় তাহলে tonsillectomy করার indication রয়েছে। আর বছরে ৩/৪ বার গলা ব্যথা এভাবে দুই বা ততোধিক সময়ের চেয়ে বেশি হলে তারও indication রয়েছে। অথচ indication ছাড়া tonsillectomy অপারেশন করার যেন হিড়িক পড়ে গেছে এই সমাজে। এটা যদি নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধতা না থাকে তাহলে তা রোধ করা কোন মতেই সম্ভব নয়। পেশাগত নৈতিকতা আমাদের এত নিচু পর্যায়ে নেমে গেছে যে, আমাদেরকে কাল কেয়ামতের মাঠে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। নাক, কানের যারাই অপচিকিৎসা করে থাকেন তাদের মনে যদি আল্লাহর ভয় থাকত, বিচার দিনের মুখোমুখি হওয়ার আশংকা থাকততাহলে এই অপকর্ম করার দুঃসাহস করতেন না কেউ। যতদিন এই চিন্তাধারা নিজের মধ্যে না আসবে ততদিন এই অপচিকিৎসার বেড়াজাল থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব না।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধসোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ দরকার
পরবর্তী নিবন্ধভাষাচিন্তা ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু