বিশ্বের যে কোনো দেশে কোনো একটি প্রকল্প হাতে নিলে অন্তত বিশ/পঞ্চাশ বছরের স্থায়িত্বের কথা মাথায় রেখে করা হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। এইখানে আবেগের বশবর্তী হয়ে ব্যক্তিগত লাভের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা বা ফিজিবিলিটি স্টাডি করে প্রকল্প হাতে নেয়া হয় না। সেজন্য অল্প কিছুদিন পর সেই প্রকল্প, হয় গুরুত্ব হারায় না হয় সেটি ধ্বংস করে বা বদলিয়ে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এতে দেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের ও সময়ের প্রচুর অপচয় হয়। যদি এভাবে অর্থের অপচয় না হতো, তবে আরো অনেক আগে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারতাম। বিষয়টি অবতারণার কারণ হলো, বছর খানেক ধরে চট্টগ্রামের অনেকগুলো স্থাপনা যেগুলো মাত্র ৫-১০ বছর আগে করা হয়েছিলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ঐসব প্রকল্প অপরিকল্পিতভাবে ও অদূরদর্শীভাবে করা হয়েছিলো। এরইমধ্যে কয়েক দিন আগে এমনই একটি স্থাপনা ভাংগার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। এইটি হলো ২ দশমিক ২৭ একর জায়গার উপর বিস্তৃত জাতিসংঘ পার্ক, যেখানে ২০১৫ সালে প্রায় ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে দুইটি সুইমিংপুল ও একটি জিমনেসিয়াম নির্মান করা হয়েছিলো। এই স্থাপনাটি ভেঙে জায়গা খালি করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে গণপূর্ত অধিদফতর। সে অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশন জায়গা খালি করার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতো টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুইটি সুইমিংপুল শুধু একদিন ২০১৭ সালের ৬ই মে-সাতার প্রতিযোগিতার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিলো। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেখানে নির্মিত জিমনেসিয়ামটি কখনোই ব্যবহার করা হয় নি। তবে সিটি কর্পোরেশন স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেললেও সেটি খালি থাকবে না। কারণ গণপূর্ত অধিদফতর জায়গাটিতে ১১ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। ‘চট্টগ্রাম জেলার পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকায় আধুনিক সুযোগ সুবিধাসম্পন্ন জাতিসংঘ সবুজ উদ্যান উন্নয়ন’ প্রকল্প নামে এখানে নির্মাণ করা হবে সীমানা প্রাচীর, প্রবেশ ফটক, অফিস, দোকান, টিকিট কাউন্টার ও শৌচাগার। জায়গাটির পুরানো অবকাঠামো ভেঙে খালি করলে এবং নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করলে দুই কর্তৃপক্ষেরই লাভ। কারণ দুই প্রক্রিয়াতেই টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে। তাই পুরানো স্থাপনা ভাঙলেও লাভ আবার নতুন প্রকল্প করলেও লাভ। তবে ক্ষতি একমাত্র দেশের জনগণের, যাদের করের টাকায় এসব স্থাপনা স্থাপন করা ও ভাঙা হয়। প্রশ্ন হলো এই যে ভাঙা গড়ার খেলা করে জনগণের কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয় এর দায় কার? শুধু জাতিসংঘ পার্কের স্থাপনা নয়, শহরের জলবদ্ধতা নিরসন ও পানি নিষ্কাশনের বাধা হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সামনে প্রবর্তক মোড়ের ও মেডিক্যাল কলেজের পশ্চিম গেইটে নির্মিত সিটি কর্পোরেশনের বহুতল ভবনগুলোও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। অথচ এগুলো করা হয়েছে কয়েক বছর আগে।
আমরা যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন নিউমার্কেটের সামনে একটি পার্ক ছিলো। যাতে সকাল সন্ধ্যায় মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করতো। তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে শাটল ট্রেনে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে (বটতলী) নেমে ঐ পার্কে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে তারপর বাসায় যেতাম। হঠাৎ একদিন দেখি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন সেখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছে। এতে সেই পার্কটির অপমৃত্যু হয়। তখন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় আরো অনেক খালি জায়গা ছিলো। যেখানে মানুষ বিকেল বা সন্ধ্যায় আড্ডা দিতো। পরবর্তীতে একে একে প্রায় সব খালি জায়গায় প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে স্থাপনা তৈরি করা হয়। এর বেশিরভাগই করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে অপরিকল্পিতভাবে করা ঐসব স্থাপনা খুব একটা কাজে লাগেনি। যেমন এক যুগ আগে করা হয় দেওয়ানহাটে সিটি কর্পোরেশনের বহুতল ভবন, যেটির বেশির ভাগ ফ্লোর এখনো খালি পড়ে আছে।তেমনি দাম পাড়া গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের সামনেও করা হয় একটি বহুতল ভবন, যেটি বহুবছর যাবত অর্ধনির্মিত অবস্থায় অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যত খালি জায়গা ছিল তার প্রায় সবগুলোতে কোন না কোন স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগ এখন গুরুত্বহীন। শুধু খালি জায়গায় নয়, একটি (সিইপিজেডের সামনে) ছাড়া শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উপর অপরিকল্পিত ভাবে করা ওভারপাস গুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বর্তমানে এগুলো ছন্ন ছাড়া ভবঘুরে লোকের অপরাধের উৎকৃষ্টতম স্থান। এগুলোতে প্রতিনিয়ত মাদক সেবন, দেহব্যবসাসহ নানান অসামাজিক কার্যকলাপ চলে। অপদস্ত হওয়ার ভয়ে সাধারণত কোন ভদ্রলোক এসব ওভার পাসে উঠে না। ডায়াবেটিস হাসপাতালের সামনে করা ওভার পাসটি নির্মাণ করার পর একদিনের জন্যও চালু করা হয় নি। অথচ ঐ ওভারপাসটির দুই পাশে চলন্ত সিড়ি (বৈদ্যুতিক এস্কেলেটর) দিয়ে তৈরি। যা তৈরি করতে কয়েক কোটি টাকা লেগেছে। বর্তমানে এটি ধুলোবালি ও রৌদবৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ার পথে। হয়ত কয়েকদিন পর এটিও ভেঙে আবার নতুন ওভারপাস তৈরি করা হবে।
আশির দশকে দেশের খেলাধুলার জগতে চট্টগ্রামের নন্দিত অনেক খেলোয়াড় আলো ছড়াতো। তখন প্রতিদিন চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন মাঠে ফুটবল ক্রিকেটসহ নানান খেলাধুলা হতো। সারাবছর দিনে ও বিকালে আউটার স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলা দেখার জন্য শত শত মানুষ হাজির হতো। আউটার স্টেডিয়াম সারা বছর বিভিন্ন টুর্নামেন্ট বিশেষ করে স্কুল কলেজ ফুটবল টুর্নামেন্ট, স্টার সামার ও নির্মাণ ক্রিকেট সহ বিভিন্ন খেলাধুলায় মুখরিত থাকতো। তখন আমরা যারা স্টেডিয়ামের কাছাকাছি থাকতাম তারা ভোরে (ফজরের নামাজের পর) দলবেঁধে ফুটবল খেলতে আউটার স্টেডিয়াম হাজির হতাম। ওখানে জায়গা না পেলে সার্কিট হাউজের সামনে শিশু পার্কের জায়গায় বা রেডিসন ব্লু’র জায়গায় ফুটবল খেলতাম। এটা যে শুধু এই এলাকায় হতো তা কিন্তু নয়, চট্টগ্রাম শহরের অন্যান্য এলাকার বিভিন্ন মাঠেও সারা বছর খেলাধুলায় মুখরিত থাকতো। আগ্রাবাদ এলাকার ছেলেরা জাম্বুরী মাঠে, দেওয়ানহাট কদমতলী এলাকার ছেলেরা পলোগ্রাউন্ডে ও চকবাজার এলাকার ছেলেরা প্যারেড মাঠে সকাল সন্ধ্যায় ফুটবল ক্রিকেটসহ নানান রকমের খেলাধুলা মেতে উঠতো।
পরবর্তীতে এইসব মাঠের বহুমুখী ব্যবহার শুরু হওয়ায় ছেলেদের খেলাধূলায় মারাত্মক ব্যঘাত ঘটে। মাঠ না থাকায় ছেলেমেয়েরা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে মোবাইল, কম্পিউটারসহ প্রযুক্তির প্রতি ঝুঁকে পড়ে। অনেকে মাদক ও পর্নগ্রাফির প্রতি এডিকটেড হয়ে পড়ে। বর্তমানে তাদেরকে শত চেষ্টা করেও খেলাধুলার প্রতি আবার আগ্রহী করা যাচ্ছে না। পলোগ্রাউন্ড ও আউটার স্টেডিয়ামে এখন সারা বছরই বিভিন্ন ধরনের মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় মাঠগুলো খেলাধূলার অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিশাল জাম্বুরী মাঠের দুইদিকেই বিনোদন পার্ক করায় খেলাধুলার সুযোগই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা প্রায়সময় অভিযোগের সুরে বলি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রযুক্তি নির্ভর ও মাদকে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি ওদের এই আসক্তির জন্য দায়ী কে? এর জন্য দায়ী আমরাই। কারণ আমরাই অপরিকল্পিত নগরায়নের চিন্তায় তাদের খেলাধুলার মাঠ নষ্ট করে তাদেরকে বিপথে ঠেলে দিয়েছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।