অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কাটায় বিপর্যয়

শীতের রাতে ৫ শতাধিক বসতঘরে পানি বন বিভাগের বোকামিতে ভাঙল স্লুইচ গেট, বসতবাড়ি, রাস্তা মএকশ হেক্টর জমির ধান ও শাক-সবজি কাদামাটির নিচে

| সোমবার , ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

শীতের রাতে ৫ শতাধিক বসতঘরে পানি বন বিভাগের বোকামিতে ভাঙল স্লুইচ গেট, বসতবাড়ি, রাস্তা মএকশ হেক্টর জমির ধান ও শাকসবজি কাদামাটির নিচে

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাতকানিয়া

সাতকানিয়ালোহাগাড়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় সোনাইছড়ি খালের মুখে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে বন ডুবিয়ে সৃষ্ট কৃত্রিম লেকের বাঁধ অপরিকল্পিতভাবে কেটে দেয়ায় গভীর রাতে তলিয়ে গেছে সোনাকানিয়ার অধিকাংশ এলাকা। এ সময় রাতের আঁধারে পানি ঢুকে ভেঙে গেছে শতাধিক বসতঘর। এছাড়া পাঁচ শতাধিক বসতঘরে ঢুকেছে পানি। ফলে কনকনে শীতে পরিবার পরিজন নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে এলাকার মানুষ। তলিয়ে গেছে প্রায় এক শত হেক্টর রোপা বোরো ক্ষেত ও মৌসুমি শাকসবজি। ভেঙে গেছে স্লুইচ গেটও। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকার রাস্তাঘাট। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে এলাকার মানুষ। স্থানীয় প্রশাসনকে না জানিয়ে এবং এলাকায় সতর্কতামূলক মাইকিং না করে রাতের আঁধারে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ কেটে দেয়ায় বন বিভাগের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। গত শনিবার রাতে উপজেলার সোনাকানিয়ায় এ ঘটনা ঘটে। এদিকে, গতকাল সকালে সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরাফাত সিদ্দিকী, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. কামরুল হোসাইন ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

সোনাকানিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. জসীম উদ্দিন জানান, চট্টগ্রাম১৫ আসনের সাবেক সাংসদ আবু রেজা নদভীর অনুসারী নাছির উদ্দিন, মনজুর আলম ও জামাল উদ্দিনসহ স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র গত কয়েক বছর আগে লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া ইউনিয়নের হরিদা ঘোনায় সাতকানিয়ার সোনাইছড়ি খালের মুখে বাঁধ দিয়ে কয়েক হাজার একর পাহাড়ি এলাকা ডুবিয়ে মৎস্য খামার গড়ে তোলে। ২ শতাধিক ফুট লম্বা ৩০৩৫ ফুট প্রস্থ ও ১০০ থেকে ১২০ ফুট উচ্চতার এই বাঁধের কারণে এতদিন সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া ও লোহাগাড়ার বড়হাতিয়া এলাকার কয়েক হাজার একর জমি পানির অভাবে শুষ্ক মৌসুমে অনাবাদি থাকে। এভাবে অবৈধভাবে বাঁধ তৈরি করে পাহাড়ি এলাকা ডুবিয়ে রেখে মৎস্য খামার করা হলেও বন বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শনিবার সন্ধ্যার দিকে স্থানীয় মানুষকে না জানিয়ে বন বিভাগের পক্ষ থেকে হঠাৎ সোনাইছড়ি খালের মুখে দেয়া বাঁধ কেটে দেয়া হয়। ফলে কয়েক হাজার একর বিশিষ্ট মৎস্য খামারের পানি সোনাইছড়ি খালের উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে না পেরে কূল উপড়ে দুই দিকে প্রবাহিত হয়। এছাড়া পানির স্রোতের টানে ভেঙে গেছে খালের ছোট হাতিয়া কালা মিয়া পাড়া এলাকায় থাকা স্লুইচ গেট। পানিতে তলিয়ে যায় সাইরতলী, আচারতলী, কালা মিয়া পাড়া, দ্বীপের কূল, কুতুব পাড়া ও মঙ্গল চাঁদ পাড়া। এসময় এলাকায় প্রায় পাঁচ শতাধিক বসত ঘরে পানি ঢুকে পড়ে। পানির তোড়ে ৬০টি মাটির গুদাম ও কাচা ঘর ভেঙে পড়ে যায়।

চেয়ারম্যান আরো বলেন, সাবেক এমপির লোকজন অবৈধভাবে খালের মুখে বাঁধ দিয়ে এক অপরাধ করেছে। অপরিকল্পিত ভাবে বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকার মানুষকে না জানিয়ে এভাবে বাঁধ কেটে দিয়ে বন বিভাগ আরেক অপরাধ করেছে। শুধুমাত্র বন বিভাগের বোকামির কারণে হাজার হাজার মানুষ পানিতে কষ্ট পেয়েছে। পানিতে বসত ঘর হারিয়েছে। তলিয়ে গেছে কৃষকের বোরো ক্ষেত ও মৌসুমী শাক সবজি। বন বিভাগ কয়েক দফায় ধীরে ধীরে পানিগুলো ছাড়লে মানুষকে এত দুর্ভোগে পড়তে হতো না। চট্টগ্রাম১৫ আসনের সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী জানান, এই বাঁধের সাথে আমার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নাই। আমার কোনো লোকজনেরও সম্পৃক্ততা নাই। বন বিভাগের সমর্থন পেয়ে স্থানীয় কিছু লোক সোনাইছড়ি খালের মুখে বাঁধ দিয়ে এই মৎস্য খামার গড়ে তুলেছে। আবার বন বিভাগ এটা কেটে দিয়েছে। প্রশাসন ও এলাকার মানুষকে না জানিয়ে এভাবে অপরিকল্পিত ভাবে কেটে দেয়ায় এলাকার হাজার হাজার মানুষ কষ্ট পেয়েছে। অনেক মানুষ বসত হারিয়েছে। তলিয়ে গেছে বোরো ক্ষেত ও মৎস্য খামার। রাস্তা ঘাটেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন বিভাগের উচিত ছিল কয়েক ধাপে পানি ছাড়া। তাহলে মানুষের ভোগান্তি হতো না। এসব অন্যায় কাজের সাথে আমি নাই। কেউ আমার কথা বললে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ জানাবো।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশ বলেন, খালের মুখে অবৈধ ভাবে বাঁধ দিয়ে বনভূমি ডুবিয়ে মৎস্য খামার করা হয়েছিল। বন বিভাগের পক্ষ থেকে সেই বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাঁধ কাটার কারণে কৃষক বা অন্য কারো কোনো ধরনের ক্ষতি হয়েছে কিনা বিষয়টি এ মুহূর্তে আমার জানা নাই।

সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস বলেন, বাঁধটি কাটার বিষয়ে বন বিভাগের পক্ষ থেকে আমাদেরকে কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি এলাকায়ও সতর্কতা মূলক কোনো প্রচারণা করা হয়নি। সন্ধ্যায় বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। আর রাতে শত শত মানুষের বসত ঘরে পানি ঢুকেছে। পানিতে অর্ধ শতাধিক বসত ঘর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেছে। অনেক বসত ঘর আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধ কাটার কারণে স্লুইচ গেইট ভেঙে গেছে এবং কৃষি বিভাগের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রাথমিক ভাবে ২ মেট্রিক টন চাল ও ২০০ পিস কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের (পদুয়া) সহকারী বন সংরক্ষক মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাঁধ কেটে দিয়ে বন বিভাগের জায়গা উদ্ধার করেছি। কিন্তু বাঁধ কাটার কারণে কারো কোনো ধরনের ক্ষতি হয়েছে কিনা এখন পর্যন্ত জানি না। ক্ষতি হয়ে থাকলে বিস্তারিত জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

সোনাইছড়ি খালের পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শামসুল আলম জানান, সোনাইছড়ি খালের মুখে বাঁধ দিয়ে পাহাড়ি এলাকা ডুবিয়ে মৎস্য চাষের কারণে সোনাকানিয়া ও বড়হাতিয়া এলাকার প্রায় অর্ধেক জমি শুষ্ক মৌসুমে অনাবাদি থাকে। ফলে এলাকার মানুষ বাঁধ কাটার পক্ষে। কিন্তু বন বিভাগ কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ করে বাঁধ কেটে দেয়ায় এলাকাবাসীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় এক হাজার কৃষকের রোপা বোরো খেত, আলু, মরিচ, বেগুন, শীম ও পেঁপেসহ মৌসুমী শাকসবজির ক্ষতি হয়েছে। বন বিভাগের ভুলের কারণে এলাকার কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে স্লুইচ গেট। ফলে কয়েক শত একর রোপা বোরো ক্ষেত নষ্ট হবে। আগামী পনের দিনের মধ্যে স্লুইচ গেট এলাকায় খালের উপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে না পারলে কৃষকরা এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারবে না। বন বিভাগ বাঁধটি ধাপে ধাপে কাটলে এমন ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না।

সোনাইছড়ি মাহাছন্যার মুড়া এলাকার কৃষক শাহ আলম বলেন, আমি ৩ কানি জমিতে বোরো রোপণ করেছি। আর ১ কানি জমিতে পেঁয়াজ ও মরিচ চাষ করেছি। বাঁধ কাটার কারণে মুহূর্তের মধ্যে আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। সব কিছু এখন কাদা মাটির নিচে চলে গেছে। ঋণের টাকায় রোপণ করা বোরো ক্ষেতের কিছুই অবশিষ্ট নাই। নতুন ভাবে যে চারা লাগাবো সেই সুযোগও নাই। এখন আমি পথের ফকির হয়ে গেছি।

কালা মিয়ার পাড়ার কৃষক সাহাব উদ্দিন বলেন, আমি ৬ কানি জমিতে বোরো এবং ১ কানি জমিতে আলু চাষ করেছি। সবগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।

সাইরতলী এলাকার কৃষক মো. ঈসমাইল বলেন, আমি ২ কানি জমিতে আলু, মরিচ ও বেগুন খেত করেছিলাম। মরিচ ও বেগুন গাছ ফলে ভরা ছিল। ঘটনার দিন রাতে আমার ক্ষেতের উপর মানুষ জাল দিয়ে মাছ ধরেছে। দেখে বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। শুধু আমার নয়, এলাকার শত শত কৃষকের ক্ষেত পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।

এদিকে, বাঁধ কাটা পাানিতে বসতঘর হারানো মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে এলাকার বাতাস। তাদেরই একজন সাইরতলীর জান্নাতুল ফেরদৌস। তিনি বলেন, রাতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভাত খেতে বসেছিলাম। ঠিক ওই সময় উঠানের দিকে পানি আসতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে ঘরে পানি ঢুকে। তখন ভাতের প্লেট রেখে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যাই। এর কয়েক মিনিট পর পুরো মাটির ঘরই ভেঙে যায়। ঘর থেকে কোনো জিনিসই বের করতে পারিনি। সবাই এক কাপড়ে বের হয়ে গেছি। সব কিছু মাটির নিচে চাপা পড়েছে।

একই এলাকার আবদুল কাদের বলেন, আমাদের চার ভাইয়ের ঘর ভেঙে গেছে। মাটির ঘর হওয়ায় পানি আসার পর নিমিষেই ভেঙে গেছে। ঘর থেকে কেউ কিছু বের করতে পারিনি। সবকিছু এখন মাটির নিচে। স্ত্রীসন্তানদের নিয়ে কোথায় থাকবো, কি খাবো বুঝে উঠতে পারছি না। এভাবে বাঁধ কেটে আমাদেরকে নিঃস্ব করে দিয়েছে।

এদিকে, সোনাকানিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানবন্ধন করা হয়েছে। গতকাল রবিবার বিকালে সোনাকানিয়ার সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য রাখেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী, সোনাইছড়ি খালের পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি শামসুল আলম, সেলিম উদ্দিন চৌধুরী, ইউপি সদস্য আহমদ কবির ভেট্টা, মো. আইয়ুব জমাদার, মহিউদ্দিন, সৈয়দ আহমদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষক সমিতির উদ্দেশ্য ভিন্ন : চবি উপাচার্য