কেউ অপরাধ করলে তার দায় ব্যক্তির, কোনো দল বা গোষ্ঠীর নয় বলে মন্তব্য করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। এসময় তিনি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের যারা সদস্য ছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কোনো একজন ব্যক্তি যদি কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে থাকে তাহলে সে ব্যক্তিটিই দায়ী হবে। তার ব্যক্তি পরিচয়, সামাজিক পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়, রাজনৈতিক পরিচয় কোনো কিছুই সামনে আসবে না; আসবে শুধু এই ব্যক্তি সন্ত্রাসী। সুতরাং কারো কোনো ক্ষোভের কারণে, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটের কারণে কাউকে কোনো সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করাটা আমরা পরিহার করি। তিনি গতকাল বুধবার দুপুরে চট্টগ্রামের উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। বক্তব্য রাখেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম, চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর শাহজাহান চৌধুরী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধি।
সভায় হাসান আরিফ বলেন, আইন অনুযায়ী তার সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য যে শাস্তি হওয়া দরকার, সেটা রাষ্ট্রদোহিতায় হোক বা আলিফের হত্যাকাণ্ডের উস্কানি দাতা হিসেবে হোক অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি পেতে হবে। আমরা এককভাবে কোনো অপরাধীর জন্য কোনো গোষ্ঠী, কোনো দল বা কোনো সংগঠনকে আঙ্গুল তুলে দেখাব না।
তিনি বলেন, এখানকার যে প্রক্ষাপট তার সম্পর্কে আমরা সবাই জানি, পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। যে সংগঠনের সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা বলা হচ্ছে ওই সংগঠন কিন্তু অস্বীকার করেছে, প্রেস রিলিজও দিয়েছে। ওই সংগঠনের সারা দেশের যারা প্রধান তাদের সঙ্গে আমাদের ঢাকায় মতবিনিময় হয়েছে, গতকালও হয়েছে। সাম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, বিশেষ করে সুতরাং গত দুই–তিন মাসের মধ্যে চট্টগ্রামে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, ধারাবাহিকভাবে কেউ যদি সংগঠনের পরিচয়ের অপব্যবহার করে থাকে সেটা তার ব্যক্তিগত অপরাধ এবং ওই ব্যক্তিই দোষী হবেন, সংগঠন নয়। সেই সাথে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীকেও যেন আমরা দোষারোপ না করি।
তিনি বলেন, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের যারা সদস্য ছিলেন তাদের আইনের আওতায় আনার সময় এসেছে। স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে অপরাধ কর্মকাণ্ডগুলো করে যাচ্ছে; যেহেতু তাদের এখন পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা হয়নি। এজন্য তারা এত কিছু করার সুযোগ পেয়েছে। তাদের এই মুহূর্তে বাইরে রাখলে, আমাদের আশঙ্কা, সমাজের আশঙ্কা যে তারা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে যাবে। এজন্য আমরা সতর্ক থাকি। পারস্পরিক সৌহার্দ্য যেটা আজীবন ছিল, আগামীতেও থাকবে সেটা বজায় রাখি এবং সকলে মিলে আমরা একটি সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গড়ি।
ধর্মের নামে সন্ত্রাসী করছে ছাত্রলীগ–যুবলীগ : ধর্মের নামে যুবলীগ–ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ক্যাডাররা এখনো মিছিল করে বেড়াচ্ছে জানিয়ে ডা. শাহাদাত হোসেন তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। তিনি বলেন, অবৈধ অস্ত্র যতক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার করা হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা মাথাছাড়া দিবে এবং এসব কাজ করবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বলেছিল তারা ক্ষমতা থেকে চলে গেলে লাখ লাখ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করা হবে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের হামলা কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের কারণে কোনো আওয়ামী লীগ নেতা তো নয়, কোনো সনাতনী সম্প্রদায় বা কোনো নাগরিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি।
আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার কথা তুলে ধরে মেয়র বলেন, আলিফকে অত্যন্ত বর্বরতার সাথে মধ্যযুগীয় কায়দায় যেভাবে প্রফেশনালি মারা হয়েছে তা পেশাদার খুনি ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। তিনি বলেন, ধর্ম বর্ণ রাজনৈতিক নাম নিয়ে সন্ত্রাসী করুক না কেন তার কোনো দল, ধর্ম বর্ণ নেই। সে সন্ত্রাসী হিসেবেই পরিচিত হবে। আর তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি পেতে হবে। তিনি বলেন, ট্রাস্টি বোর্ডের যে তিনজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অনতিবিলম্বে তাদের অব্যাহতি দিতে হবে। ওইসব সন্ত্রাসীরা টাকা ঢালছে। আমরা জানি কারা টাকা ঢালছে। সবাইকে আমরা চিনি। কারণ এই চট্টগ্রাম শহরে আমরা নতুন নয়, এখানে বড় হয়েছি। সাবধান হয়ে যান আপনারা কি কারণে করছেন সব জানা আছে। বীর চট্টগ্রাম যখন ফুসে ওঠবে তখন কেউ রেহাই পাবেন না।
তিনি বলেন, আপনারা যে ধরনের সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার জন্য কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার জন্য, দাঙা লাগার জন্য, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করার জন্য যে কাজগুলো করছেন শক্ত হাতে সেগুলোর জবাব দেওয়া হবে। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। শাহাদাত বলেন, এ ধরনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা চিহ্নিত, তারা সন্ত্রাসী। তাই নিরীহ নির্দোষ সম্প্রদায়ের ভাইদের ওপর যাতে কোনো ধরনের অনাচার অত্যাচার না হয়। আমরা সবাই চট্টগ্রামের সন্তান। এই চট্টগ্রামেই বাস করতে হবে। আর কেউ যেন হত্যাকাণ্ডের শিকার না হয়।
অভিযোগের জবাবে যা বললেন সিএমপি কমিশনার : সভায় এডভোকেট রেজাউল প্রশ্ন তুলে বলেন, ঘটনার সময় পুলিশের কি ভূমিকা ছিল? রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি কিভাবে বুক ফুলিয়ে হাঁটে? চিন্ময় দাশ যে মামলার আসামি, একই মামলার অন্য আসামি সেখানে অর্গনাইজ করেছে। এখানে ছিল হাজারী গলি মামলার এজাহারনামীয় আসামি, মার্ডার কেসের আসামি। আমার ভাইয়ের রক্ত যেখানে পড়েছে সেখানে ডিসি লেবেলের কোনো অফিসার কেন যায়নি।
এরপর আরেকজন অভিযোগ করে বলেন, ফজলে করিম চৌধুরীকে যেদিন কোর্টে আনা হয় সেদিন পুরো আদালত এলাকা সেনাবাহিনী ও বিজিবি দিয়ে ঘেরাও করে ফেলা হয়। সেখানে চিন্ময় দাশকে এত হালকাভাবে নেয়ার কারণ কী। ওনার সাঙ্গপাঙ্গকে কেন ওখানে ঢোকার সুযোগ করে দিল কে? সেটার বিষয়ে তদন্ত চাচ্ছি।
এসব অভিযোগের জবাবে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) সকাল ৮টা থেকে আমাদের দুইজন এডিশনাল কমিশনারের নেতৃত্বে ডিসি, এসি, ওসি সবাই আদালত কেন্দ্রিক মাঠে ছিল। পর্যাপ্ত পরিমাণ ফোর্স ছিল। সেখানে বিজিবি, আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়ন বাইর থেকে নিয়ে আসা হয়, সবাই ছিল। হত্যাকাণ্ডের সময় পুলিশ ঠেকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু পারেনি। হত্যাকাণ্ডের সাথের সাথে হরিজন পল্লীতে অভিযান চালানো নিয়ে একটু নিরাপত্তার বিষয় ছিল। কারণ আদালত প্রাঙ্গণে প্রায় দুই হাজারের বেশি লোক ছিল এই প্রটেস্টে এবং তারা খুব ভায়োলেট মুডে ছিল। ওসময় সেখানে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত আমরা উপযুক্ত মনে করিনি। পরবর্তীতে সেখানে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওখান থেকে ২৭ জন লোক গ্রেপ্তার করা হয়, পাহাড়তলী থানা থেকেও আরো ছয়জন গ্রেপ্তার করা হয়। আর্মিও রাতের বেলা হাজারী গলিতে অভিযান চালায়, সেখানেও গ্রেপ্তার আছে। তিনি বলেন, সারারাত অভিযান চালানো হয়। অফিসাররা যায়নি বা ছিল না কথাটা তথ্য নির্ভর নয়। তিনি বলেন, রাতের বেলা হরিজন পল্লী থেকে যে ২৭ জন গ্রেপ্তার করা হয় তার মধ্যে ৬ জন সকলেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। যে স্লোগান দেয় তাকে চকবাজার থানা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনকে স্পেস দেয়া হবে না : বৈষম বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ৫ আগস্টের পর ভয় সংখ্যালঘুদের একটা ভয় দেখানো হয়েছিল তাদের সম্পদ, জমি দখল করা হয়েছে। কিন্তু আপনারা দেখেছেন, আলেম সম্প্রদায় যারা আছেন তারা মন্দির এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পাহারা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই বাংলাদেশে প্রত্যেকটি ধর্মের অধিকার থাকবে। প্রত্যেকটি ধর্মের সহাবস্থান থাকবে। কিন্তু কোনো ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনকে বিন্দু পরিমাণ স্পেস দেয়া হবে না। আমাদের ব্যবহার করে কেউ যদি সার্বভৌমত্বে আপস করে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী সরকার ও আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যারা সবসময় আপোষ করেছেন তারা সবসময় সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম বলেন, বাংলাদেশে আমাদের পরিচয় বাংলাদেশি। প্রত্যেকে যার যার জায়গা থেকে ধর্ম পালন করব। যে উগ্রবাদী তার পরিচয় উগ্রবাদী, সে ধর্মেরই হোক। তিনি বলেন, আমরা যে ধর্মেরই হয় না কেন আমাদের এই স্টেটম্যান দেয়া দায়িত্ব; যে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত, যে নারকীয় হত্যাকাণ্ডে যুক্ত তিনি আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত হতে পারে না।
নগর ছাত্রদলের সাবেক সহ–সভাপতি সৌরভ প্রিয় পাল বলেন, সাধারণ কোনো হিন্দু এ ঘটনায় জড়িত নয়। তাদের যেন হয়রানি করা না হয়।