অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি : বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে

| বুধবার , ১১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

সামপ্রতিক সময়ে খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা রীতিমত উদ্বেগজনক। ঘটনাগুলো সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এসব খুনের বেশির ভাগই ঘটেছে সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। সাধারণত পারিবারিক কলহ, অর্থ লেনদেন, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব বা এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের হাতে এঁরা খুন হয়েছেন। আশঙ্কাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে পারিবারিক হত্যাকাণ্ড। অপর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪/১৫ জন খুন হচ্ছেন। তবে এসব খুনের বেশিরভাগ ঘটছে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে। বাবা অথবা মা নিজের শিশু সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করছেন। বাবা অথবা মাও খুন হচ্ছেন সন্তানের হাতে। রাস্তা বা ডোবা থেকে উদ্ধার হচ্ছে তরুণীর খণ্ডিত লাশ। এতে উদ্বেগউৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। এভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যাকাণ্ড।

গত ৯ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে ‘সামাজিক অস্থিরতাই কি দায়ী’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের মাঝ থেকে। মানবীয় গুণাবলী হারিয়ে মানুষ হিংস্র প্রাণীর মতো আচরণ করছে। নৃশংসতাই যেন এখন শেষ কথা। ঘরেবাইরে সর্বত্র। প্রতিপক্ষ কিংবা স্বজন; কেউই এই নৃশংসতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সময়ের আবর্তনে সভ্য মানুষ হিসেবে মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ যেখানে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, সেখানে মানবতাবোধ প্রতিনিয়ত কমছে। আজকাল প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত হতে হয়, একটি ঘটনা নিয়ে হাহুতাশ করতে না করতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে আরও নৃশংস কায়দায়। পরকীয়া সন্দেহে নিজের স্ত্রীকে খুনের আলোচনার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আলোচনার জন্ম দিচ্ছে সম্পত্তির জন্য দুই পুত্র মিলে পিতাকে খণ্ডবিখণ্ড করার ঘটনা।

আমরা শান্তির কথা বলি, মিলনের কথা বলি, উজ্জ্বলতার কথা বলি, নীতির কথা বলি, সত্যের কথা বলি, সাফল্যের কথা বলি। এমনকি এসব কথা শুনতেও পছন্দ করি; কাজের বেলায়ও এসবের জন্য নিজেকে সঁপে দিতে ভালো লাগে। কিন্তু যখন দেখা যায় দশের তুলনায় নিজের থলেটা তেমনভাবে পূর্ণ হচ্ছে না; তখনই বিবেক হয়ে ওঠে হিংস্র। তাই হয়তো শ্বশুর হাসান আলী খুনের মামলায় পুত্রবধূ আনারকলি গ্রেপ্তারের পর বলতে পারে, ‘ঘটনার সময় আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি।’ কেন এই অস্থিরতা? এর উত্তরে অপরাধ বিশেষজ্ঞ, নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনরা বলছেন, সামাজিক অস্থিরতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ও প্রযুক্তির প্রসারের কারণে ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যেমন আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে, তেমনি পারিবারিক সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক অনুশাসনের প্রতি জোর দেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

আজাদীর প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলোজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, আগে সমস্যা হলে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে নিতো। সভ্যতার বিকাশে নগরায়ণ ও শিল্পায়ন যখন হয়েছে, তখনই মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এর মধ্যে সম্পত্তি একটা বড় কারণ হয়ে উঠছে। আগের তুলনায় জমির মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। ফলে পরিবারের মধ্যেই পিতা, মাতা, ভাইবোন একে অপরের সঙ্গে বিরোধ বাড়ছে। জমির জন্য মাকেবাবাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ভাই ভাইকে ও বোনকে হত্যা করছে। যত বেশি আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় যাবেন, তত বেশি সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার বা মানসিক অস্থিরতা বাড়বে।

সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক বন্ধন ঢিলে হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বিচারহীন সংস্কৃতির কারণে এ সংকট ক্রমাগত ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান, যারা অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও মানসিক অশান্তিতে থাকে, তাদের একটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। একটি অংশ অপরাধের শিকার হয়। তাঁরা বলেন, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ আছে। কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তাহীনতা। কাজের নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা, সুস্থ সমাজের নিরাপত্তাএই বিষয়গুলো যে কোনো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে। মানুষ মানসিকভাবে হিংস্র হয়ে ওঠছে। যা মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তুুলছে। দেশের গত কয়েক মাসের অপরাধ পরিসংখ্যানে সে চিত্রই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এ বিষয়ে সরকারসহ আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। এ নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। সর্বোপরি বিচারের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১০২ কিলোমিটারে ট্র্যাক বসানোর কাজ শেষ
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬