সকাল ১১ টা। নগরীর কারিতাস মিলনায়তনটি ধরতে গেলে পরিপূর্ণ নানাবয়সী, নানা শ্রেণিপেশার নারী পুরুষের উপস্থিতিতে। থরে–থরে সাজানো গোল–গোল টেবিলে তারা বসেছেন। ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, কক্রাবাজার, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকেই এসেছেন। কেউ সাংবাদিক, কেউবা নারীনেত্রী, কেউ উন্নয়নকর্মী, কেউবা শিক্ষক, আইনজীবী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, হরিজন, দলিত সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গ থেকে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরাও বাদ যায়নি কেউ–ই। তারা সেদিন বসেছিলেন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করে মতামত প্রদানের উদ্দেশ্যে। আর বিষয়টি হলো– অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নারী আন্দোলনের দাবিনামাগুলোর সুনির্দিষ্টকরণ এবং এর সঠিক বাস্তবায়নের রূপরেখাকে নীতিনির্ধারণী তুলে ধরার প্রত্যয়।
মূলতঃ নারীপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে নারীর অধিকার অর্থাৎ নারীর ওপর সহিংসতা, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সমঅধিকার নিয়ে কাজ করে আসছেন। বর্তমানে নারীদের অবস্থান এবং নারীদের এগিয়ে চলার পথকে কিভাবে সুগম করা যায়, সেই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে তারা নারীমুক্তি সমতা এবং ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিতকরণ ও করণীয় পদক্ষেপ নিয়ে দাবিনামা সরকারের কাছে তুলে ধরার লক্ষ্যেই দেশব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করে। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত কর্মশালাটি ও তাদের ধারাবাহিক কর্মসূচির একটি অংশ বলা যায়।
নারীপক্ষ ঢাকার মাহিন সুলতান, জাহানারা এবং দুর্বার নেটওয়ার্ক চট্টগ্রামের সমন্বয়কারী দনাই প্রু নেলী এবং চট্টগ্রামের নারী নেত্রী জেসমিন সুলতানা পারু, আমি সাংবাদিক ডেইজী মউদুদ, এডভোকেট বদরুন্না্হার কলিসহ বিভিন্নস্থান থেকে আগত শ্রেণিপেশার নারী পুরুষের অংশগ্রহণে কর্মশালা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়ে উঠে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং বৈষম্যবিরোধীরা শিক্ষার্থী, দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গ এবং যৌনকর্মীদের উপস্থিতি এই কর্মশালাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্রী তার চমৎকার ও সাবলীল বক্তব্যে কর্মশালার বিভিন্ন বিষয় ও বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত দিকগুলোকে ব্যাখ্যা করেন। অন্যদিকে কুমিল্লা থেকে আসা এক কলেজ অধ্যক্ষ তাঁর অভিজ্ঞতা ও মতামত ব্যক্ত করেন যুক্তি সহকারে। ঠিক একই ভাবে ফাল্গুনী হিজড়া, ছাত্রী তামান্না, বৈষম্যরিোধী শিক্ষার্থীরাও স্বতঃস্ফুর্ত আলোচনায় বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যৌক্তিক দাবিনামা পেশ করেন। শুরুতেই সমন্বয়ক দনাই প্রু নেলী তাঁর কথামালায় অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। পরে পরিচিতি পর্ব, এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে অংশগ্রহণকারীদের জন্য ফ্লোর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বিভিন্নজন বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য মতামত প্রদান শেষে নারী পক্ষের মাহিন সুলতান অংশগ্রহণকারীদের দলভিত্তিক আলোচনায় আহ্বান জানান। মোট ৮ টি দলে বিভক্ত ৪৫ জন অংশগ্রহণকারী এই কর্মশালায় বিষয়ভিত্তিক মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরেন। বিষয়গুলো হলো নারীস্বাস্থ্য, ইহজাগতিক রাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহিংসতামুক্ত নারীর জীবন, নারীর অর্থনৈতিক অধিকার, নারীর রাজনৈতিক অধিকার, প্রান্তিক পর্যায়ের নারীর (যৌনকর্মী, দলিত, হরিজন, তৃতীয় লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধী) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং জলবায়ু ও পরিবেশগত ন্যায় বিচার। আলোচনার সুবিধার্থে প্রতিটি বিষয়কে তিন ধরনের প্রস্তাবনায় বিভক্ত করা হয়। ১. নীতি সংক্রান্ত, ২. কাঠামো সংক্রান্ত এবং ৩. সেবা সংক্রান্ত। কর্মশালায় নির্ধারিত বিষয়গুলো যদিও এক স্বল্প সময়ে শেষ করা অত সহজ ছিল না, তবুও নবীন প্রবীণ উপস্থিতি এবং নানা শ্রেণিপেশার অংশগ্রহণকারীদের আলোচনায় অতি অল্প সময়ে উঠে আসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যু। কর্মশালায় বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী নবাগত। এদের কাছে কর্মশালা নতুনত্ব পাওয়ার পাশাপাশি প্রবীণ আর নবীনের মেলবন্ধনে সেদিনের কর্মশালাটি পায় ভিন্ন এক মাত্রা। কর্মশালাশেষে উপস্থিত সকলে পার্বত্য এলাকায় সংঘটিত সহিংসতা ও নাশকতার প্রতিবাদে এক মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে এই ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
আসলে নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা, অধিকারগুলো কি কি? নারীদের জন্য সংবিধানে কি কি সুবিধাগুলো রয়েছে, তা অনেকদিন পর্যন্ত অজানা ছিল। নারী সংগঠন, বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রমমূলক সংগঠন ( জিও, এনজিও) গুলোর কল্যাণে বিগত কয়েক দশকে শিক্ষিত, পেশাজীবী এমনকি একেবারে তৃণমূল নারীরাও আজ অনেক সচেতন নিজেদের প্রাপ্য অধিকার আর মর্যাদা সম্পর্কে। যেসব নারী কখনো ঘরের চার দেয়ালের বাইরে তো দূরের কথা, ঘরেও কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতামত দিতে পারেনি, তাঁরা আজ ঘরের বাইরে এসে নিজেদের সুবিধা অসুবিধা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, প্রত্যাশা প্রাপ্তির কথা বলছেন বিনা সংকোচে, অবলীলায় অবশ্যই সাহসিকতার সাথে। তাদের অভিনন্দন আর সাধুবাদ জানাই। নারীর পথচলা দিনে দিনে আরো সুন্দর ও মসৃণ হোক এই প্রত্যাশা।