অনুমোদনের তিন বছরেও নিয়োগ হয়নি ঠিকাদার

চসিকের এলইডি বাতি প্রকল্প ।। দরপত্র অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৩ পূর্বাহ্ণ

একনেকে অনুমোদনের দীর্ঘ তিন বছর পার হলেও শুরু হয়নি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পের কাজ। এমনকি ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়নি। ওল্টো ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। দরপত্রে অংশে নেয়া ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়া বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন এবং পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিআর) লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। অথচ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং চসিকে দেয়া ওই অভিযোগ জমা দেয়ার ছয়দিন পর অনুষ্ঠিত দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভায় প্রাথমিকভাবে এগিয়ে রাখা হয়েছে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে। তাছাড়া চসিকের একটি তদন্ত প্রতিবেদনে ৪২ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পের কাজে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে দরপত্রে এগিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতীয় ঋণ সহায়তা প্রকল্পের অধীনে ‘মডার্নাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্স এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১৯ সালের ৯ জুলাই প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। ২০২১ সালের নভেম্বর মাস থেকে প্রকল্পের দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু হয়। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের এক্সিম ব্যাংক তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শর্ট লিস্ট পাঠায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- এনার্জি ইফিসিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড, সিগনিফাই ইনোভেশন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড এবং শাপর্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। একইভাবে বাংলাদেশের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয় প্রকল্পের জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড, এইচটিএমএস লিমিটেড ও ফটো স্টার লিমিটেড। শর্ট লিস্টের প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নেয়। বাছাই শেষে ভারতীয় একটি ও বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হবে যারা যৌথভাবে কাজ করবে।
কালো তালিকাভুক্ত ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান : নানা অনিয়মের কারণে ২০২০ সালের ১০ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৪টি প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠান মালিককে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল সরকার। এর একটি ‘মেসার্স এএসএল’। যার মালিক আফতাব আহমেদ। এদিকে এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পে দরপত্রে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠান ‘এইচটিএমএস লিমিটিডে’ এর মালিকও আফতাব আহমেদ। অর্থাৎ ভিন্ন নামে কালো তালিকাভুক্ত মালিকের প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে দরপত্রে। তাছাড়া ‘মেসার্স এএসএল’ কে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের জন্য বাজার মূল্যের অধিক টাকায় এমআরআই মেশিন ক্রয় করার অভিযোগে ২০২০ সালের মার্চ মাসে মামলা করেছে দুদক।
সামগ্রিক বিষয়গুলো তুলে ধরে ‘এইচটিএমএস লিমিটিডে’ এর বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের অভিযোগ করে ভারতের ‘সিগনিফাই ইনোভেশন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এর মহাব্যবস্থাপক মিলিন্দ ডেসপাণ্ডে গত ২৫ জুলাই চসিকে লিখিত অভিযোগ করে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময় এইচটিএমএস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চসিকে জমা দেওয়া হলফনামায় (সিরিয়াল নম্বর ৫৬) দাবি করেন, তিনি বা তার মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান কখনোই কালো তালিকাভুক্ত বা অযোগ্য বিবেচিত হননি।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়, কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সত্ত্বার ক্ষেত্রে প্রকল্পটির আন্তর্জাতিক দরপত্র ডকুমেন্টসে বলা হয়েছে, একজন আবেদনকারী যাকে ভারত বা নিয়ম মেনে সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহণকারী দেশের কোনো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সংস্থা কালো তালিকাভুক্ত করেছে, বর্জন করেছে বা অযোগ্য হিসেবে অনুমোদন করেছে সেই প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এদিকে দরপত্রে অংশ নেয়া ভারতীয় আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দেশটির বিহার রাজ্যে উন্নয়ন কাজে অনিয়ম করার অভিযোগ আছে।
একই ব্যক্তির দুই প্রতিষ্ঠান : ২০০৮ সালের পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন) অনুযায়ী একই ব্যক্তির মালিকানাধীন দুইটি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। তবে এলইডি প্রকল্পে দরপত্রে অংশ নেয়া ‘এইচটিএমএস লিমিটিডে’ এবং ‘ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড’ এর সঙ্গে একই ব্যক্তির সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। অথচ চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রে এইচটিএমএস লিমিটেড এর পরিচালক হিসেবে প্রকৌশলী মো. মাহবুব হোসাইনের নাম রয়েছে। আবার ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও তার নাম রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনেও মিলেছে অনিয়ম : জাইকার অর্থায়নে নগরের ৭৫ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি স্থাপনে চারটি প্যাকেজে ৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় এইচটিএমএস লিমিটেডেকে ২০২০ সালের ১৪ মে কার্যাদেশ দেয়া হয়। একই বছরের ৯ জুন প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পের আওতাভুক্ত সড়ক আছে ৩০টি। প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর তা তদন্তের সিদ্ধান্ত দেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এর প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি গত জুন মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রকল্পের আওতায় যেসব ক্যাবল লাগানো হয়েছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, স্থাপিত বৈদ্যুতিক তারের বিভিন্ন স্থানে স্পার্ক সৃষ্টি হয় এবং এতে প্রতীয়মান হয় তারের গুণগত মান সঠিক নয়। স্থাপিত ক্যাবলের মান মোটেও সন্তোষজনক নয়। বৈদ্যুতিক পোলের জন্য যে মানের বেইজ (সিসি) টেন্ডার ডকুমেন্ট এর স্পেসিফিকেশনে ধরা হয়েছে তা বাস্তবে বসানো পোলের ক্ষেত্রে যুতসই নয়। এটা আরসিসি হওয়া বাঞ্চনীয় ছিল।
তবুও এগিয়ে আছে : গত ১ আগস্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা পৃথক পৃথক নম্বর প্রদান করে দরপত্রে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানকে। এতে চসিকের এক প্রকৌশলী অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান এবং ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে (দুই প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করতে চায়) ৯৫ এর অধিক নম্বর দিয়েছেন। বিপরীতে অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠানকে ৫০ এর নিচে নম্বর দিয়েছেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় হৈ চৈ পড়ে গেছে চসিকসহ মন্ত্রণালয়ে।
সাধারণ সভায় ক্ষোভ : দীর্ঘদিনেও প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় গত ২৮ আগস্ট চসিকের সাধারণ সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। সভায় কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, প্রকল্প পরিচালকের অদক্ষতা ও অযোগ্যতার কারণে প্রকল্পটিতে দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন। এ সময় অন্যান্য কাউন্সিলরগণও বিষয়টি সমর্থন করেন।
এর আগে প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে ১৬তম সাধারণ সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। গত সপ্তাহে দৈনিক আজাদীকে তিনি বলেন, আমরা মূল্যায়নপত্র ভারতের এঙ্মি ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছি। আমরা চাচ্ছি প্রকল্পটি যেন দ্রুত বাস্তবায়ন হয়। দরপত্রে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠান মালিকের কালো তালিকাভুক্তির বিষয়টি জানতাম না।
প্রকল্প পরিচালক ও চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঝুলন কুমার দাশ গত শুক্রবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা কাউকে চূড়ান্ত করিনি। গাইড লাইন অনুযায়ী মূল্যায়ন শেষে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট এঙ্মি ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছি। তারা ভোটিং করে সিদ্ধান্ত দেবে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানতে পারব। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযোগটি আমরা কোয়ারি করেছি। যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা জানিয়েছে একই ব্যক্তির দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়নি। আফতাব আহমেদের প্রতিষ্ঠানও অংশ নেয়নি বলে জানিয়েছে। জয়েন্ট স্টক রেজি: এও দুই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক ব্যক্তির সম্পৃক্ততার তথ্য পাইনি।
ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান সে দেশের একটি রাজ্যে অনিয়ম করা এবং কালো তালিকাভুক্ত অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বাছাই করেছে ভারতীয় এঙ্মি ব্যাংক তাই সেটার জবাব তারা দিবেন। প্রতিষ্ঠানগুলো তারাই বাছাই করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকল্পের টাকা ফেরত যাওয়ার শঙ্কা
পরবর্তী নিবন্ধসেপ্টেম্বরের মধ্যে ২০ ওয়ার্ডে সম্মেলন করার টার্গেট