সারা দেশে চলছে সুদ-ঘুষের অবৈধ মেলা, যেন ছেয়ে গেছে সারাদেশের আকাশ আর বাতাস। এ অবৈধ রমরমা ব্যবসায় জড়িত সরকারি শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অধঃস্তন পর্যায়ের কর্মচারী পর্যন্ত। সুদের ব্যাপারে মহান রাব্বুল আ’লামিন স্পষ্টভাবে পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা সুদ নিশ্ছিহ্ন করেন, আর দান-সদকাকে তিনি বৃদ্ধি করেন; আল্লাহতায়ালা অকৃতজ্ঞ ও পাপিষ্ট ব্যক্তিদের কখনো পছন্দ করেন না’-সূরা বাকারা-২৭৬। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা যারা ঈমান এনেছ, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না এবং তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমরা সফল হতে পারবে’-সূরা ইমরান-১৩০। সুদের ভয়াবহতা সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সুদ খায়-তারা দাঁড়াতে পারবে না, তার দাঁড়ানো হবে সে ব্যক্তির মতো, যাকে শয়তান নিজস্ব পরশ দিয়ে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে; এটা এ জন্যে যে, এরা বলে-ব্যবসা বাণিজ্য তো সূদের মতোই, আল্লাহতায়ালা ব্যবসা হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন, তাই তোমাদের যার কাছে তার মালিকের পক্ষ থেকে এ উপদেশ পৌঁছেছে, সে সুদের কারবার থেকে বিরত থাকবে, আগে যা হয়েছে তা তো তার জন্যে-সে বিষয়টি আল্লাহতায়ালার সিদ্ধান্তের ওপর; কিন্তু যে ব্যক্তি (এই আদেশের পরেও আবার সুদী কারবারে) ফিরে আসবে, তারা অবশ্যই জাহান্নামের অধিবাসী হবে, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে’-সূরা বাকারা-২৭৫। এখন অফিস-আদালতে, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি- বেসরকারি সংস্থা, বিভিন্ন এনজিও, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা-সবখানেই সুদ ও ঘুষের অসম্ভব সয়লাব। সরকারি-বেসরকারি চাকরী পেতে হলে দিতে হয় মোটা অংকের ঘুষ, নয়তো বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চাকরি তো দূরের কথা-চাকরির ছোঁয়াও পাবে না। ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে দিতে হয় মোটা অংকের ঘুষ আবার সরকারি চাকুরিদের মাসিক বেতনের সাথে জুড়িয়ে দেয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমাণের সুদ। বলাবাহুল্য, আপনার আমার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে সুদ নামক ভয়ংকর অজগর সাপ। অনেক পাপিষ্ট ব্যক্তি অন্যকে ধার দেয়ার নামে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের সুদ। সেসব সুদখোর লোকেরা কবর থেকে অজ্ঞান অথবা পাগলের মত বিভ্রান্ত হয়ে উত্থিত হবে। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, যারা সুদ ভক্ষণ করে তাদেরকে কেয়ামত দিবসে শৃঙ্খলিত বন্দি হিসাবে কবর থেকে তোলা হবে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে স্বপ্নে দেখানো হয়েছিল, যে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বোখারী (রহঃ), ঘটনাটি হল : ‘যখন আমি লাল রং বিশিষ্ট একটি নদীতে পোঁছি যার পানি রক্তের মত লাল ছিল, তখন আমি দেখি যে, এক লোক অতি কষ্টে নদীর তীরে আসছে। কিন্তু তীরে একজন মালাক বা ফেরেশ্তা বহু পাথর জমা করে বসে আছেন এবং তার পাশে আরও একজন মালাক রয়েছেন। নদীতে থাকা লোকটি সাঁতরে তীরের কাছে আসার সাথে সাথে একজন মালাক তার মুখ হা করে ধরছেন এবং অপর মালাক তার মুখে পাথর ভরে দিচ্ছেন। তখন সে ওখান থেকে পলায়ন করছে। অতঃপর পুনরায় এই রুপই হচ্ছে’ সম্প্রতি টিআইবি’র এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিবন্ধীদের ভাতার তালিকায় নাম লেখাতে ঘুষ গুণতে হচ্ছে এক থেকে তিন হাজার টাকা। অনিয়ম ও দুর্নীতির অশুভ থাবায় নিষ্পেষিত কপালপোড়া আমাদের দেশের প্রতিবন্ধীরাও। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রতিবন্ধীদের ভাতার কার্ড দিতে বেআইনিভাবে টাকা নিচ্ছেন, এমনকি তাদের একাংশ প্রতিবন্ধীদের ভাতার অংশবিশেষ আত্মসাৎও করছেন। টিআইবি’র গবেষণায় উঠে এসেছে-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা পাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার উপর। যেহেতু জনপ্রতিনিধিরা অবৈধ ভোটের উৎসবে মেতেছিল-মোটা অংকের টাকা দিয়ে মানুষ জোগাড় করে নিজেদের ভোট নিজেদের আয়ত্তে এনেছে, তা উসুল করার জন্যে চেপে বসেছে প্রতিবন্ধীদের ঘাড়ের উপর। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজসেবা কার্যালয়ে কর্মরত অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদবিরে এমন অনেককে ভাতার কার্ড দেওয়া হচ্ছে, যারা প্রতিবন্ধী নন-যার ফলে সত্যিকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কার্ড পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৯ থেকে ১০ শতাংশ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ১৬ শতাংশ এখনো সরকারি ভাতার আওতায় আসেনি। টিআইবি’র গবেষণায় এসেছে-উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের একাংশ প্রতিবন্ধীদের ভাতার টাকা আত্মসাতে জড়িত। এভাবেই দেশের প্রতিটি সেক্টরে পাহাড়সম দূর্নীতি-অনিয়ম, সূদ আর ঘুষের যেন মেলা বসেছে। পরীক্ষায় প্রমোশন পেতে গেলেও লাগে ঘুষের টাকা, বাণিজ্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি) নির্বাচনের ক্ষেত্রেও লাগে বিরাট অংকের টাকা। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে লোভনীয় চাকরি নামক সোনার হরিণটা পেতে লাগে মোটা অংকের ঘুষ, ইনকাম ট্যাঙ পরিচ্ছন্ন করার জন্য লাগে বড় অংকের ঘুষ-নইলে ব্যক্তিগত অফিস বা চেম্বারে হানা দেয় অসাধু আয়কর কর্মকর্তারা, ফাইল আটকে রাখেন বছর বছর, হয়রানি করেন সারাদিন-সারাবেলা। ইনকাম ট্যাঙের অসৎ কর্মকর্তা কর্মচারীদের খপ্পরে পড়েননি এমন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে অধঃস্তন পর্যায়ের কর্মচারী পর্যন্ত অসাধু কর কর্মকর্তাদের খপ্পরে পড়েন এবং নিজের আয়কর শুধরে নেয়ার জন্যে মোটা অংকের টাকা তাঁদের গুণতে হয়। বাংলাদেশে টিআইএন ধারীদেরকে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয়। অসাধু কর কর্মকর্তারা বাসা-অফিস-চেম্বারে অঘোষিতভাবে হানা দেয় বার বার, প্রতিনিয়ত করে প্রচন্ড হয়রানি, ঘুমকে হারাম করে দেয় ওরা। দুর্নীতির অভয়ারণ্য হয়েছে কর কর্মকর্তাদের কার্যলয়সমূহ কিন্তু ভুক্তভোগীরা অজানা আশংকায় মুখ খুলতে সাহস পায় না। সুদ ও ঘুষের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন-যা ইমাম বায়হাকি, ইবনে জারির ও ইবনে আবি হাতিম হযরত আবু সাইদ আল্ খুদরী থেকে বর্ণনা করেন-মিরাজের রাত্রে আমাকে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন এমন একদল লোকের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের পেট এক একটি ঘরের মত প্রকান্ড। এত বড় পেট নিয়ে তারা ভালোভাবে চলাফেরা করতে পারে না। ফলে তারা চলতে গিয়ে নিজেদের পথ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। যে পথ দিয়ে ফেরাউন ও তার দলবলকে সকাল-বিকাল দোজখের কাছে নেয়া হয়, ঐ লোকগুলি এক একবার সেই পথের ওপর চলে আসে এবং নির্বোধ ও শ্রবণশক্তিহীন বিপথগামী উটের মত চলতে থাকে। এই বড় ভুড়িওয়ালা লোকগুলো যখন টের পায় যে, ফেরআউন ও তার দলবলকে আনা হচ্ছে, তখন তারা উঠি-পড়ি করে পালাতে চায়। কিন্তু পেট নিয়ে নড়তে না পারায় তারা রাস্তা ছেড়ে সরে যেতে পারেনা। ফলে ফেরআউন ও তার দলবল এসে তাদের ওপর চড়াও হয় এবং একবার পেছনের দিকে ও আরেকবার সামনের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় ও নিয়ে আসে। কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত তারা এভাবে শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। রাসূল (সা.) বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ওহে জিবরীল, এরা কারা? তিনি বললেন ঃ ওরা সুদখোর, যারা শয়তানের স্পর্শে উন্মাদ হয়ে যাওয়া লোকের মত চলে। যারা সুদ খায় তাদের জন্যে গুনাহ রয়েছে ৭০টি, তন্মধ্যে সর্বনিম্নপর্যায়ের গুনাহ হচ্ছে নিজ মায়ের সাথে যেনা করা আর সর্বোচ্চ পর্যায়ের গুনাহ হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করা। মহান রাব্বুল আ’লামিন পবিত্র কালামে পাকে বলেন, ‘আর যদি তোমরা এমনটি না কর, তাহলে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের (ঘোষণা থাকবে), যদি তোমরা ফিরে আস তাহলে তোমরা তোমাদের মূলধন ফিরে পাওয়ার অধিকারী হবে, তোমরা অন্যের উপরে জুলুম করো না, তোমাদের উপরও অতপর কোন জুলুম করা হবে না’-সূরা বাকারা-২৬৯।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল