বাঙালির দুর্নাম আছে-ইতিহাসকে তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। ইতিহাসকে ভুলে থাকা মানে বাস্তবতার দিকে অগ্রসর না হওয়া। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না। বাঙালি জাতির ইতিহাসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসব্যাপী যুদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল তা হলো বাঙালি জাতির শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস। ইতিহাসের পঠন-পাঠনে কালের বিবর্তনে বিস্মৃত অধ্যায়ে যুক্ত হয়। তেমনি একজন অধ্যাপক পুলিন দে। ছিলেন আমৃত্যু আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি ১৯৫৫ সালে মন্ত্রী ছিলেন বিষয়টি তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ নেই। মনে হয় এসব ব্যাপার তাঁর কাছে উল্লেখযোগ্য ঠেকেনি। বরং সাধারণভাবে রাজনৈতিক ঘটনাবলী নিয়ে যুক্ত ছিলেন। তাঁর কাছে জীবনের অন্যতম ঘটনা মাস্টারদা সূর্যসেনের রিপাবলিকান দলে যোগ দেওয়া।
পুলিন দে’র জন্ম ১৯১৪ সালের ১ অক্টোবর পটিয়ার ধলঘাটে। বাবা সারদা কুমার দে, আর মায়ের নাম সাবিত্রী দেবী। তিন বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। বাবা ডাক কর্মচারী। কৈশোরে কাকী তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছিলেন। পড়াশোনা করেছিলেন ধলঘাট হাই স্কুলে। ধলঘাট স্কুলে পড়াকালীন তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন দীনেশ দাশগুপ্ত, সুধাংশু বিশ্বাস ও হৃদয় চৌধুরী। এখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন প্রথম বিভাগে। তারপর সব পরীক্ষাই দিয়েছিলেন জেল থেকে। ১৯৩৫ সালে হিজলী বন্দি নিবাস থেকে আাইএ, রংপুর জেল থেকে ১৯৩৭ সালে বিএ এবং প্রেসিডেন্সী জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪৪ সালে এমএ পাস করেন। সবগুলো পরীক্ষা হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
কৈশোরে পুলিন দে যোগ দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে। বন্ধুদের মধ্যে যোগ দেন দীনেশ দাশগুপ্ত, সুধাংশু বিশ্বাস, অজিত বিশ্বাস, হৃদয় চৌধুরী, নিত্যগোপাল চৌধুরী প্রমুখ। ‘পরে অরো অনেক তরুণ দলে যোগ দেয়। আমাদের গোষ্ঠীটি ছিল একটি শক্ত ও দৃঢ়চিত্ত নিবেদিত প্রাণ। তাই মাস্টারদা আমাদের অত্যধিক স্নেহ করতেন। আমরা নিজেদের বিশ্বাস, উপলব্ধি দেশপ্রেম ও দলের প্রতি আনুগত্য প্রদানে দৃঢ়সংকল্প ছিলাম।’ (মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ ঃ পৃষ্ঠা-৪৭-৪৮)। পুলিন দে মা, মাটি, দেশকে ভালবাসতে শেখেন ম্যাটসিনি ও গ্যারিবল্ডির জীবনী পড়ে। তবে গ্যারিবল্ডির জীবনী তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।
১৯২৮ সাল, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪। ধলঘাটে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনর সাথে মাস্টারদার দলের যে সংঘর্ষ হয় তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রত্যক্ষভাবে। এ কারণে তাঁকে ১৯৩২ সালে কারাবরণ করতে হয়েছে। মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। ১৯৩৯ সালে যোগ দেন জয় প্রকাশ নারায়ণের সমাজতন্ত্রী দলে। এই দলের সঙ্গে তখন যুক্ত ছিলেন রামমনোহর লোহিয়া, অশোক মেহতা, গুণদা মজুমদার প্রমুখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ধলঘাটে নিজ গ্রামে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৪২ সালে আবার তাঁকে ভারত রক্ষা আইনে বন্দি করা হয়। প্রথমে আটক ছিলেন ঢাকা জেলে, তারপর প্রেসিডেন্সী জেলে। জেলখানা হয়ে ওঠে লেনিনের ভাষায় ইউনিভার্সিটি ফর দ্য পলিটিক্যাল ক্যাডার। ১৯৪৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর পার্টির কাজ শুরু করেন। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। সমাজতন্ত্রী দলের রামমনোহর লোহিয়া কলকাতায় আসেন ১৭ আগস্ট জনসভা করার জন্য। মুসলিম লীগের কর্মীরা সে সভা পণ্ড করে দেয় এবং ড. লোহিয়া আক্রান্ত হন। লোহিয়া তখন পুলিন দে’কে একটি ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে দিল্লীতে পাঠান পণ্ডিত নেহেরুর কাছে। নেহেরু ক্ষুদ্ধ স্বরে পুলিন দে’কে বলেন, ‘অস্ত্রাগার যারা লুট করতে পারে তারা মুসলিম লীগের গুণ্ডাকে দমন করতে পারে না! আমি বললাম, নিশ্চয় পারি কিন্তু কংগ্রেস সেটা সইতে পারবে! মৌলানা আজাদ আমাকে শান্ত করে বললেন, তুমি উত্তেজিত হয়ো না।’
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হলে পুলিন দে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে থেকে যান এবং পাকিস্তান সোসালিস্ট পার্টি গঠন করেন। অল পাকিস্তান সোসালিস্ট পার্টির তিনি যুগ্ম সম্পাদক এবং পূর্ব-পাকিস্তানের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময়ই ১৯৫০ সালে ঢাকা সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মীরসরাই, ফেনী, নোয়াখালী আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় যোগও দিয়েছিলেন। সোসালিস্ট পার্টি থেকে চারজন প্রার্থী সে সময় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য মনোনীত হন। ইতোমধ্যে সামরিক আইন জারি হলে এবং নিউইয়র্ক যাওয়ার বদলে ধলঘাটে নিজগৃহে অন্তরীণ হন। অনেকটা বাধ্য হয়ে ধলঘাট হাই স্কুলে যোগ দেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় অবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুক্তি মেলে এক বছর পর। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পুলিন দে’র সোসালিস্ট পার্টি গড়ে তুলে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেড। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সাথে পুলিন দে’র সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনটি প্রস্তাব সরাসরি উত্থাপন করেন। এক. পাকিস্তান থেকে আনীত সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে না নেয়া। দুই. মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ না করিয়ে বরং অস্ত্রসহ সেনাবাহিনী নেয়া। তিন. রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী চক্রকে অন্তত পাঁচ বছর দমিয়ে রাখা। উপস্থিত অনেকে প্রস্তাবগুলো সমর্থন করলেও খন্দকার মুশতাকসহ মুজিবের অন্ধ ভক্তরা এককথায় প্রত্যাখ্যান করে।
চিরকুমার পুলিন দে’কে রাজনীতির অধোগতি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমরা রাজনীতি করেছি পকেটের পয়সা দিয়ে, ব্যাংকের টাকায় নয়।’ জীবনসায়াহ্নে ‘ইয়ামি দ্য হিট’ বইটি তাঁর মনে বেশ রেখাপাত করেছিল। জীবনের শেষ দুই যুগের বেশি সময় কাটিয়েছেন জয়নগরস্থ ছোট বোন বিভার বাসায়। বোনের স্বামী ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক পি কে ভট্টাচার্য্য, গণিতবিদ হিসেবে ছিল দেশজুড়ে খ্যাতি। প্রায় বছর খানেক শয্যাশায়ী থাকার পর ২০০০ সালের ১১ অক্টোবর পুলিন দে পরলোকগমন করেন। তিনি দলকে ভালোবাসেন। দলের জন্য সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়। এসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে দেশকে ভালোবাসা যাবে।
লেখক : সহ সম্পাদক, দৈনিক আজাদী