বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক ত্যাগী রাজনীতিক আজ বিস্তৃত, অনুচ্চারিত। তেমনি একজন হলেন অধ্যাপক পুলিন দে। আমৃত্যু ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। এই রাজনীতিকের জন্ম ১৯১৪ সালের ১ অক্টোবর। বাবা সারদা কুমার দে, মা সাবিত্রী দেবী। তিন বোন, দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। বলা যেতে পারে তাঁর জন্ম ‘এক গরিব চাষির পর্থ কুটিরে’। কেননা, বাবা ছিলেন ডাক কর্মচারী। পটিয়ার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণকারী পুলিন দে ম্যাট্রিক পাস করেন ধলঘাট হাই স্কুল থেকে। ম্যাট্রিক তিনি প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন। তারপর সব পরীক্ষাই দিয়েছিলেন জেলে বসে। ১৯৩৫ সালে হিজলী বন্দি নিবাস থেকে আইএ, রংপুর জেল থেকে ১৯৩৭ সালে বিএ এবং প্রেসিডেন্সি জেল থেকে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৪৪ সালে পাস করেন এমএ। এসব পরীক্ষা হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।
কৈশোরেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে। ১৯২৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে ধলঘাটে ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের সঙ্গে মাস্টারদার দলের যে সংঘর্ষ হয় তার সাথে যুক্ত ছিলেন পুলিন দে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম গ্রেপ্তার হন ১৯৩২ সালে। মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৩৯ সালে যোগ দেন জয় প্রকাশ নারায়ণের সমাজতন্ত্রী দলে। এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রামমনোহন লোহিয়া, অশোক মেহতা, গুণদা মজুমদার প্রমুখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪০ সালে ধলঘাটে নিজগ্রামে অন্তরীণ রাখা হয়। মুক্তি মেলে এক বছর পর। ১৯৪২ সালে পুলিন দে আবার ভারত রক্ষা আইনে বন্দি হন। প্রথমে আটক ছিলেন ঢাকা জেলে। তারপর প্রেসিডেন্সি জেলে। ১৯৪৫ সালে মুক্তির পর আবার পার্টির কাজ শুরু করেন। জেলা পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতায় মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করে। সমাজতন্ত্রী দলের রামমোহন লোহিয়া কলকাতায় আসেন ১৭ আগস্ট জনসভার করার জন্য। মুসলিম লীগের কর্মীরা সে সভা পণ্ড করে দেয় এবং ড. লোহিয়া আক্রান্ত হন। ড. লোহিয়া তখন পুলিন দেকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে দিল্লি পাঠান পণ্ডিত নেহেরুর কাছে। নেহেরু চিঠি পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিনদেকে বলেন, ‘অস্ত্রাগার যারা লুট করতে পারে তারা মুসলিম লীগের গুণ্ডাকে দমন করতে পারেনা! আমি বললাম, নিশ্চয় পারি কিন্তু কংগ্রেস সেটা সইতে পারবে? মৌলানা আজাদ আমাকে শান্ত করে বললেন, তুমি উত্তোজিত হয়ো না।’ ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে পুলিন দে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। গঠন করেন পাকিস্তান সোসালিস্ট পার্টি। অল পাকিস্তান সোসালিস্ট পার্টির তিনি যুগ্ম সম্পাদক এবং পূর্ব পাকিস্তানের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনীতি সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার সময় ঢাকার সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ১৯৫০ সালে। ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হন পুলিন দে। দুই বছর আটক থাকার পর মুক্তি পান। যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মীরসরাই–ফেনী–নোয়াখালী আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। সে সমময় সোসালিস্ট পার্টি থেকে চারজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তুু তখনই সামরিক আইন জারি করা হয় এবং জাতিসংঘ যাওয়ার বদলে ধলঘাটে নিজ ঘরে অন্তরীণ হন। অনেকটা বাধ্য হয়ে ধলঘাট হাই স্কুলে যোগ দেন প্রধান শিক্ষক হিসেবে। ১৯৬৫ সাথে পাক–ভারত যুদ্ধের সময় আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। দেশ স্বাধীন হলে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে পুলিন দের সাক্ষাত ঘটে। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এক. পাকিস্তান থেকে আনা সৈন্যদের সেনাবাহিনীতে না নেয়া। দুই. মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ না করিয়ে বরং অস্ত্রসহ সেনাবাহিনীতে নেয়া। তিন. রাজাকার–আলবদর–আলশামসসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে অন্তত পাঁচ বছর দমিয়ে রাখা। উপস্থিত অনেকে সমর্থন করলেও খন্দকার মোশতাকের মতো ‘মুজিব ভক্তরা’ এককথায় প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে পুলিন দে’কে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। এ দফায় জেল খাটেন চার বছর। মুক্তি পাওয়ার পর আওয়ামী লীগেই ছিলেন আমৃত্যু। মিলিটারি রক্তচক্ষু তাঁকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। রাজনীতির গতি–প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন হতাশ। কারণ রাজনীতি ব্যবসায়ীদের পকেটে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তবে এর আগে থেকে রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যেতে শুরু করে। ‘অনেক প্রার্থী–যারা জেল খেটেছে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, নমিনশেন দেওয়া যায় নাই; যেমন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজকে নমিনেশন দেওয়া যায় নাই। তার পরিবর্তে একজন ব্যবসায়ীকে নমিনে দেওয়া হয়েছিল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা–২৫৩)। তখন মনোনয়নবঞ্চিত লোক অনেকে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেন না। তখনকার রাজনীতিতে গুণগত মান ছিল। ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো রাজনীতিকে দৃর্বৃত্তায়ন করতে শুরু করে। রাজনীতি চলে যেতে থাকে ব্যবসায়ী–মুনাফাখোরদের হাতে। এসব পুলিন দে’কে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন ‘আমরা রাজনীতি করেছি পকেটের পয়সা দিয়ে ব্যাংকের টাকায় নয়।’ জীবনের শেষ দুই যুগ কাটিয়েছে চট্টগ্রামের জয়নগরে ছোট বোন বিভার বাসায়। প্রায় এক বছর বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় কেটেছে জীবন। ২০০০ সালের ১১ অক্টোবরে পুলিন দে পরলোকগমন করেন। ধলঘাটে নিজ বাড়িতে রাষ্ট্্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সারা জীবন কেটেছে দেশ–মাতৃকার মুক্তির জন্য। আজ অধ্যাপক পুলিন দে অন্যদের কথা বাদ দিলাম, নিজ দলেই বিস্মৃত এক নাম। এসব নির্লোভ, নিরহংকারী, দেশপ্রেমী রাাজনীতিকের জীবন থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। ওপারে ভালো থাকুন পুলিন দে।
লেখক : সহ–সম্পাদক, দৈনিক আজাদী