অতীত

জোবায়ের রাজু | সোমবার , ২০ মে, ২০২৪ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

টিকেট বিক্রির একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে আমি টিকেট কিনেছি। তাও একেবারে শেষ টিকেটটা। ভাগ্য ভালো আজকের দৈনিকে ন্যাশনাল ক্লাবের সংগীত সন্ধ্যার টিকেট বিক্রির নিউজটা চোখে পড়েছে। সেখানে প্রকাশিত নাম্বারে কল করে শেষ টিকেটটা কিনেছি। সংগীতে আমার সেভাবে কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু এই একক সংগীত সন্ধ্যায় বিখ্যাত গায়ক মাশুক আলী গাইবে বলে আমি টিকেট কিনে সে একক সংগীত সন্ধ্যার দর্শক হতে রাজী হয়েছি।

আজকের এই যে স্বনামধন্য গায়ক মাশুক আলী, দেশ জোড়া যার কোটি ভক্ত, অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত, বছরের বেশিরভাগ সময় যার বিদেশ শো তে সময় কাটে, সে আমার শুধু প্রিয় শিল্পীই নয়, আমার বাল্যবন্ধুও। একই নিভৃত পল্লীতে আমাদের বেড়ে উঠা। ক্লাসে আমরা পাশাপাশি বসতাম। পড়ায় সেভাবে মেধাবী না হলেও মাশুক গান করত দুর্দান্ত। গানের জন্য সারা স্কুল জুড়ে তার সুনাম। যে কোন সংগীত অনুষ্ঠানে মাশুকের ডাক ছিল বাধ্যতামূলক। আমাদের স্কুলের সত্যবাবু স্যার বলতেন ‘ও আমার দেশের মাটি গানটার সুর ধরতো..।’ মাশুক তখন তার দরাজ গলা ছাড়লেই পুরো ক্লাস নীরব হয়ে যেত।

সখ্যতাটা আমার সাথে বেশী ছিল বলে অনেকে আমাদেরকে ‘মানিক জোড়’ বলত। আর্থিক দিক থেকে মাশুকের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে আমি মাঝে মধ্যে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতাম। লজ্জায় টাকা নিতে চাইতো না বলে আমি জোর করে তার হাতে টাকা ভরে দিতাম।

সেবছর পাড়ার এক গানের অনুষ্ঠানে মাশুকের অপূর্ব গলাটা কানে লেগেছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক চিত্রপরিচালকের। মাশুককে তিনি ঢাকায় নিয়ে গেলেন এবং একটি সিনেমায় গাওয়ার সুযোগ দিলেন। গান রিলিজ হওয়ার পর রাতারাতি হিট মাশুক।

অনায়াসে সংগীত ভুবনের একজন হয়ে উঠে সে। বদলে যায় তার পুরো পরিবারের জীবন ধারা। শহরবাসী হয়ে উঠে মাশুকের পরিবার। গ্রামের সাথে জন্মন্তরের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়।

মাশুককে মিস করতে থাকলাম আমি। ব্যস্ততা তাকে এতই গ্রাস করে রাখে যে গ্রামে আসার সুযোগই পায় না। রোজ রেডিওতে তার গান শুনতাম। টেলিভিশনেও দেখতাম একান্ত টক শো তে। তাকে দেখে বোঝা যেত সে এখন আর অভাবে নেই। লাখ টাকার মালিক হয়েছে। সমাজে পরিচিতি পেয়েছে একজন গায়ক হিসেবে।

.

দর্শক সারিতে আমি বসে আছি। এক্ষুণি শুরু হবে মাশুক আলীর একক পরিবেশনা। মঞ্চে তার আসার অপেক্ষায় দর্শক স্রোতা। অপেক্ষায় আছে মিউজিশিয়ানরা।

নীল পাঞ্জাবী পরে মাশুক আলী মঞ্চে উঠতেই করতালি পড়ে গেল। এতটা বছর পর স্বয়ং মাশুক আমার সামনে। বুক খাঁ খাঁ করে উঠল। একবার খুব ইচ্ছে হল দর্শক সারি থেকে উঠে গিয়ে মাশুককে জড়িয়ে ধরে বলি ‘দোস্ত আমি তোর গান শুনতে নয়, তোকে দেখতে এসেছি। পনেরশ টাকা দিয়ে টিকেট কিনেছি।’

সুরের জলসায় মেতে উঠল মাশুক। একে একে তার জনপ্রিয় গানগুলি সব গেয়ে যাচ্ছে। আমার বার বার চোখ ভিজে আসে। আমার বন্ধুর গলায় এক আশ্চর্য সুর দিয়েছেন স্রষ্টা। এই যে সবার পছন্দের গায়ক মাশুক আলী, সে আমার বাল্যবন্ধু। কি ভাগ্য আমার।

.

আয়োজন শেষের দিকে। মাশুক মঞ্চ থেকে নামতে চেয়েও নামতে পারছে না। ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরেছে। নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ভক্তদের ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটে পোজ দেয়ার এলাহী কান্ড বেশ চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। উপচে পড়া ভিড় ঠেলে আমার সারা মন মাশুকের সমুখে যাবার তাড়নায় পাগল পারা। না, কোনভাবেই তার মুখোমুখি হওয়া যাচ্ছে না। এত এত ভক্তের ঢল। বিজলীর মত ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।

অবশেষে অনেক সাধনার পর কাঙ্খিত মানুষটার মুখোমুখি হবার সুযোগ পেলাম। কণ্ঠে রাজ্যের ব্যাকুলতা এনে বললাম ‘দোস্ত, আমি বাবু। চিনতে পেরেছিস?’ চেহারায় চিন্তার ভাঁজ এনে সে বলল ‘কোন বাবু জানি?’ উৎফুল্ল গলায় বললাম ‘তোর বাল্যবন্ধু। ওই যে বারাহী নগর গ্রামে আমরা বেড়ে উঠেছি।’ খুব স্বাভাবিক গলায় মাশুক বলল ‘ও আচ্ছা। একটু একটু মনে আছে। ছবি তুলবেন? আসেন পাশে দাঁড়ান। আমার খুব তাড়া। অন্য একটা প্রোগ্রাম করতে হবে।’ আমি নিথর গলায় বললাম ‘ইয়ে মানে।’

ধাক্কার মত খেলাম মাশুকের কথায়। এত বছর পর আমাকে দেখে সে কোন আগ্রহ দেখালো না। লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইলাম। আমি তার সাথে ছবি তুলতে আসিনি। এসেছি অনেক দিনের লালিত মানুষটাকে দেখতে। যার সাথে এক সময় আমার বন্ধুত্ব ছিল।

গানের জলসা শেষে সবাই যার যার গন্তেব্যে ধাবিত। আমার চোখের সামনে দিয়ে দামী গাড়িতে করে চলে গেল মাশুক, যে অতীত ভুলতে বসেছে, অথবা ভুলে যাবার ভান ধরেছে।

সে এখন আমার বাল্যবন্ধু মাশুক নয়। গায়ক মাশুক আলী। শিল্পী জীবনের প্রাচুর্য, খ্যাতি আর আভিজাত্যে বাস করতে করতে অতীত ভুলে যাওয়া একজন গায়ক মাশুক আলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধখুম্বু আইসফল