নগরীর ট্রাফিক সিস্টেমকে আধুনিকায়ন করার উদ্যোগ পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। মোড়ে মোড়ে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে জ্বলা লাইটগুলো নিয়ন্ত্রণে অটো ট্রাফিক সিগন্যাল প্রবর্তন করার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। নগরীর পুরো ট্রাফিক সিস্টেমকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগও ভণ্ডুল হয়ে গেছে। ফলে অটো ট্রাফিক সিগ্যানালের ব্যাপারটি এখন নিজেই যেন অটো হয়ে আছে! চট্টগ্রাম মহানগরী ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিবেচনায় গড়ে উঠেনি মন্তব্য করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে অটো ট্রাফিক সিস্টেম গড়ে তোলা একটি অসম্ভব ব্যাপার।
নগর পরিকল্পনার সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরীতে প্রয়োজনের তুলনায় রাস্তার পরিমাণ একেবারেই কম। মানসম্পন্ন একটি শহরে রাস্তার পরিমাণ অন্তত ত্রিশ শতাংশ থাকলেও চট্টগ্রামে এই সংখ্যা নয় শতাংশ। যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে কম। চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু কিংবা কালুরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটিই মূলত প্রধান সড়ক। এর বাইরে অলংকার মোড় থেকে ট্রাংক রোড, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে স্ট্যান্ড রোড, কাপাসগোলা রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোডসহ ৫১৭টি পিচ ঢালা রাস্তা রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ইট বিছানো রাস্তা রয়েছে ৬৭৮টি। বেশ কিছু কাঁচা রাস্তাও রয়েছে। নগরীতে সর্বমোট এগারশ’ কিলোমিটারের মতো রাস্তা রয়েছে। এর মধ্যে পিচঢালা পথগুলোতেই মূলত গাড়ি চলাচল করে বেশি।
নগরীতে সর্বমোট ১৩৫টি ক্রসিং রয়েছে। এরমধ্যে চৌরাস্তার মোড় রয়েছে ৯৭টি এবং তিন রাস্তার মোড় রয়েছে ৩৮টি। নগরীর মোড়গুলোর অধিকাংশতেই ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে। সিগন্যালে লাইটও রয়েছে। কিন্তু এই সিগন্যাল তেমন কোনো কাজে লাগে না। পুলিশ হাতের ইশারায় গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে। তারা হাত বাড়িয়ে গাড়ি আটকায়, আবার বাঁশি বাজিয়ে ছাড়ে। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে (কোনো কোনো পয়েন্টে সাতটা) রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশ ডিউটি করে। কয়েকটি পয়েন্টে রাতেও ট্রাফিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করে।
বছর কয়েক আগে ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলার সময় নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের ধারাবাহিকতায় প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে ১০টি মোড়ে ডিজিটাল ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম এবং ১৫টি মোড়ের হেলোজেন লাইটিং সিস্টেম চালু করা হয়েছিল। সংখ্যার কাউন্ট ডাউনের মাধ্যমে রাস্তা পারাপার নিয়ন্ত্রণ করার সিস্টেম সম্বলিত এই ট্রাফিক সিগন্যাল সৌন্দর্যবর্ধন করেছে ঠিকই, কিন্তু একদিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি। কোনো কোনো মোড়ে লাইটগুলো সারাদিনই জ্বলে। কাউন্টডাউন হয়। আবার কোনো কোনো মোড়ে লাইট আর জ্বলে না। এসব লাইট কিংবা কাউন্টডাউনে কোনো গাড়ি চলাচল করে না।
নগরীর যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের। অন্যদিকে সিগন্যাল বাতি লাগানোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশন এবং পুলিশের সমন্বয়ের কোনো অভাব ঘটলে পুরো প্রক্রিয়াটি মাঠে মারা পড়ার উপক্রম হয়। নগরীর ট্রাফিক সিস্টেম আধুনিকায়নের পুরো প্রক্রিয়াটি এভাবেই মাঠে মারা পড়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, ১৯৮৯-৯০ সালে নগরীর গুরত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে সিগন্যাল বাতি লাগানোর মাধ্যমে নগরীতে সিগন্যাল লাইট স্থাপন শুরু হয়েছিল। ইতোমধ্যে নগরীর ৪২টি মোড়ে সিগন্যাল লাইট স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষন ও ব্যবহারের অভাবে ট্রাফিক লাইটগুলোর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ট্রাফিক সিস্টেমের বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়নে নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। হাতের ইশারার পরিবর্তে অটো সিগন্যালিং এর মাধ্যমে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য ট্রাফিক বিভাগ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়েছিল। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাথে সমন্বয় করে ট্রাফিক সিগন্যালিং সিস্টেমকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখেনি। অটো ট্রাফিক সিস্টেমের পথে কিছুটা অগ্রসর হয়েও মুখ থুববে পড়েছে পুরো কার্যক্রম।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীতে অটো ট্রাফিক সিগন্যাল গড়ে তোলার একটি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশন থেকেও একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিছু লাইট টাইট লাগানো হয়েছিল। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। চট্টগ্রাম মহানগরী ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিবেচনায় গড়ে উঠেনি। যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে রাস্তা নির্মিত হয়েছে। কোনো পরিকল্পিত রাস্তা নেই। কোথাও বড় রাস্তার মোড়, সাথেই ছোট রাস্তার। জিইসি মোড়ের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, মোড়ের আগে বিশাল চওড়া রাস্তা, কিন্তু মোড় পার হলেই রাস্তা সরু হয়ে গেছে। রাস্তায় বড় এবং দ্রুত গতির গাড়ির পাশাপাশি সমানতালে চলে রিকশা ঠেলা ভ্যানসহ স্বল্পগতির সব গাড়ি। এই ধরনের অবস্থায় অটো ট্রাফিক সিগন্যাল বাস্তবায়ন অসম্ভব বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি মন্তব্য করেন।