পরিবহন জ্বালানিতে পেট্রল, ডিজেলের চাহিদা ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে সিএনজি নির্ভর যানবাহনও। আর দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এলপিজি অটোগ্যাস। সিএনজির জায়গাও দখল করে নিচ্ছে এসব তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। সিএনজিচালিত যানবাহনগুলো অটোগ্যাসে রূপান্তর করা হচ্ছে। তবে এসব পেট্রোলিয়াম গ্যাসের রিফুয়েলিং স্টেশন হিসেবে পরিচিত ‘অটোগ্যাস স্টেশন’ স্থাপনে আইনের তোয়াক্কা করছেন না প্রভাবশালীরা। আবার বিস্ফোরক অধিদপ্তরই মানছে না সরকার ঘোষিত নীতিমালা। বিষয়টি নিয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেনের সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়। তিনি বলেন, ‘এলপিজি অটোগ্যাস প্লান্ট নির্মাণে অনুমতি দেয় ঢাকা থেকে। তদারকিও করা হয় ঢাকা থেকে। অনুমতি দেওয়ার কোনো চিঠিও আমাদের দেওয়া হয় না। যে কারণে আমাদের কাছে অটোগ্যাস প্লান্টের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।’
তিনি বলেন, ‘কোন সুনির্দিষ্ট অটোগ্যাস প্লান্টের বিষয়ে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শকের কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হলে কিংবা পরিদর্শন করার জন্য আমাদের চিঠি দেওয়া হলে আমরা দেখি। যে কারণে চট্টগ্রামেও কয়টি অটোগ্যাস প্লান্ট রয়েছে, কয়টি আবেদন করেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের নেই, আমরা সংরক্ষণও করি না।’ ২০১৬ সালে অটোগ্যাস স্থাপন নীতিমালা করে সরকার। ‘এলপিজি অটোগ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশন ও রূপান্তর ওয়ার্কশপ স্থাপন, পরিচালন এবং রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা- ২০১৬’র ৩.১ ধারার (গ) এর (১) উপধারায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত অটোগ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশনের অবস্থান এমন স্থানে হতে হবে যাতে সড়কে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়; (২) উপধারায় বলা হয়েছে রিফুয়েলিং স্টেশনের প্রাঙ্গণ সড়কের বাঁক, ঢাল, সংযোগস্থল এবং ব্রিজ হতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত হতে হবে; (৫) উপধারায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত রিফুয়েলিং স্টেশন উচ্চচাপ বৈদ্যুতিক তারের নিচে স্থাপন করা যাবে না। (ঘ) উপধারায় বলা হয়েছে, অটোগ্যাস স্টেশনের আয়তন সিটি কর্পোরেশন ও জেলা শহরের আওতাভুক্ত এলাকায় ন্যূনতম ১০ কাঠা (রাস্তা বরাবর সম্মুখভাগের দৈর্ঘ্য ন্যূনতম ১০০ফুট এবং প্রস্থ ন্যূনতম ৭০ ফুট) এবং সিটি কর্পোরেশন ও জেলা শহরের আওতা বহির্ভূত এলাকায় ন্যূনতম ১২ কাঠা (রাস্তা বরাবর সম্মুখভাগের দৈর্ঘ্য ন্যূনতম ১২০ ফুট এবং প্রস্থ ন্যূনতম ৭০ফুট) হতে হবে। ৩.২ ধারায়- অটোগ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশন স্থাপনের অনুমোদন নেওয়ার আগে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ভূমির অবস্থানগত ছাড়পত্র এবং প্রবেশপথ ব্যবহারের লক্ষ্যে সড়ক ও মহাসড়ক অধিদপ্তরের অনুমোদন ও চুক্তিপত্র সহকারে আবেদন করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে সিএনজি গ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশন না থাকার সুবাদে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের বেশ কয়েকটি উপজেলায় একটি চক্র কাভার্ডভ্যানে করে অবৈধভাবে সিলিন্ডারভর্তি গ্যাস এনে সিএনজি অটোরিকশা ও হালকা যানবাহনে রিফিল করে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই স্থান দখল করছে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস)। সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজারেও বসছে এলপিজি রিফুয়েলিং স্টেশন। বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিয়ে ‘অটোগ্যাস’ স্টেশন নামে এসব রিফুয়েলিং স্টেশন বসানো হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কক্সবাজারের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর এলাকায় আগের পেট্রোলপাম্পে বসানো হয়েছে অটোগ্যাস স্টেশন। এখানে অটোরিকশাগুলো রিফুয়েলিং করতে আসে নিয়মিত। রাত ৯টার দিকে একের পর এসব থ্রি-হুইলার এসে ভিড় করে এই অটোগ্যাস স্টেশনে। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচলে বিধি নিষেধ থাকার কারণে রাতের বেলায় মহাসড়ক ডিঙিয়ে অটোগ্যাস নিতে আসে থ্রি-হুইলারগুলো। বেশ কয়েক বছর ধরে কাভার্ড ভ্যানের ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ গ্যাস কিনে চলছিলো এখানকার অটোরিকশাগুলো।
সরকার জ্বালানিখাতের বড় বড় শিল্পগ্রুপকে এসব অটোগ্যাস স্থাপনের অনুমতি দিয়েছে। শিল্পগ্রুপগুলো থেকে স্থানীয় উদ্যোক্তারাও ফ্রাঞ্চাইজি হিসেবে অটোগ্যাস বসানোর এজেন্ট নিয়ে থাকে। এই ধরণের একটি ফ্রাঞ্চাইজি হচ্ছে ‘কাজী অটোগ্যাস রিফুয়েলিং স্টেশন’। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ার হুলাইন এলাকায় বসানো ইউনি গ্যাস ব্রান্ডের এই অটোগ্যাস স্টেশনটি স্থাপনে কোনো নীতিমালাই মানা হয়নি। একইভাবে মইজ্জারটেক এলাকায় ‘কর্ণফুলী সিএনজি এন্ড ফিলিং স্টেশন’ নামে পুরনো পেট্রল পাম্পে নতুন করে যুক্ত অটোগ্যাস প্লান্টটি বসানোর ক্ষেত্রে নীতিমালা মানা হয়নি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা সশরীরে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়ার পরই এসব স্টেশন নির্মাণের অনুমতি পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নীতিমালায় সড়কের সম্মুখভাগে ন্যূনতম ১২০ ফুট মুখ থাকার কথা থাকলেও কাজী অটোগ্যাস স্টেশনে ৬০ ফুটও রাখা হয়নি। আবার সড়কের বাঁক, ঢাল, সংযোগস্থল এবং ব্রিজ হতে নিরাপদ দূরত্বে অটোগ্যাস প্লান্ট বসানোর নিয়ম থাকলেও একটি কালভার্টের মুখেই বসানো হয়েছে এটি। অন্যদিকে কর্ণফুলী সিএনজি এন্ড ফিলিং স্টেশনটির উপর দিয়ে গেছে বিদ্যুৎ বিভাগের উচ্চ ক্ষমতার সঞ্চালন লাইন। দুইক্ষেত্রেই নেওয়া হয়নি সড়ক ও জনপথ বিভাগের পূর্বানুমতিও। তাছাড়া অতিসম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরীতে একেরপর এক গড়ে উঠছে অটোগ্যাস স্টেশন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটছে।
কাজী অটোগ্যাস স্টেশনের উদ্যোক্তা কাজী মো. শহীদুল আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স রয়েছে। স্টেশনের সামনে বড় করে ঝুলিয়ে দিয়েছি।’ একইভাবে কর্ণফুলী সিএনজি এন্ড ফিলিং স্টেশনের ম্যানেজার শ্যামল দাশের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এলপিজি স্টেশনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। অন্য পার্টনার এটি করেছে। আমি কিছুই জানি না।’ দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান দুটি এলপিজি রিফুয়েলিং স্টেশন করার আগে আমাদের কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি। কালভার্টের সাথে লাগোয়া এই ধরণের স্টেশনের অনুমতি দেওয়ারও সুযোগ নেই।’
প্রশ্ন হলো, নিয়ম না মেনেও কীভাবে এই লাইসেন্স পেলো স্টেশনটি। অভিযোগ রয়েছে, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট পরিদর্শকরাই সার্ভে প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালাকে তোয়াক্কা করছেন না। অর্থের বিনিময়ে তারা প্রতিবেদন দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অনেক উদ্যোক্তা।
অটোগ্যাস ফ্রাঞ্চাইজি স্থাপনের ক্ষেত্রে দপ্তরের কোন গাফিলতি থাকলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘আমি অতি সম্প্রতি বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দায়িত্ব নিয়েছি। আমার সময়ে এ ধরণের কোনো ফ্রাঞ্চাইজি নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তারপরেও নীতিমালার বাইরে কারো অটোগ্যাস স্টেশন নির্মাণের কিংবা লাইসেন্স পাওয়ার সুযোগ নেই। আগের কোনো ফ্রাঞ্চাইজি অনুমোদনে কারো অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই বিভাগীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’