অটিজম শিশুর মা-বাবার ডিনাইল মুড বা অস্বীকারের ধাঁধা

অধ্যাপক (ডাঃ) মাহমুদ আহমেদ চৌধুরী | শনিবার , ২ মার্চ, ২০২৪ at ৭:১১ পূর্বাহ্ণ

ডিনাইল মুডের বাংলা অর্থ হচ্ছে অস্বীকারের ধাঁধাঁ বা মানসিকতা। মনবিশ্লেষকের মতে এটি এক ধরনের আত্মরক্ষামূলক প্রচেষ্টা। একজন ব্যক্তি কোন একটি বাস্তবিক প্রেক্ষাপট বা ঘটনাকে স্বীকার করতে বা অস্বীকার করতে ভীষণভাবে অস্বস্তিতে থাকে এবং বাস্তবকে অবাস্তব বা সঠিক নয় বলে নানা ধরনের যুক্তি বা তথ্য উপস্থাপন করতে থাকে। এই বাস্তব অস্বীকারের মাধ্যমে কোন ব্যক্তি তার দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে। বিশিষ্ট মনোরোগ বিশ্লেষক সিকমিন প্রড প্রথমে এই ধারনাটি দেন। ডিনাইল মুডের অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোন সমস্যা সম্পর্কে কথা বলতে নারাজ। কোন একটি বিয়োগাত্বক ঘটনাকে ধনাত্মক ঘটনায় উপস্থাপন করতে নানা রকম যুক্তি প্রদর্শন করা। আসলে এটি একটি অসহায়াত্বক প্রকাশের বহিপ্রকাশ মাত্র।

আমাদের কাছে অটিজমসহ নানা ধরনের বিশেষায়িত শিশু আসে। তাদের মাবাবারাও তার শিশুটি একটি বিশেষায়িত শিশুতে পরিণত হয়েছে সেটা মানতে নারাজ। চেম্বারে এসেই বলে “সব ভালো, কিন্তু একটা সমস্যা আছে তাও আবার ততোটা নয়”। একটা ঘটনা বলি কক্সবাজার থেকে একটি দম্পতি আমার কাছে আসে তাদের ৪ বছরের একটি বাচ্চাকে নিয়ে। বেশ ফুটফুটে একটি সুন্দর ছেলে, উজ্জল জামা পড়েছে কিন্তু চেম্বারে ঢুকতেই কান্না করতে লাগলো। অস্বাভাবিক জোরে জোরে শব্দ করছে এবং কান্নার কারণ বুঝা যাচ্ছে না। সাধারণত ৪ বছরের কোন ছেলে চেম্বারে ঢুকতে না চাইলে “চলে যাবো, “ডাক্তারের কাছে যাবো না” ইত্যাদি বলে কাঁদতে থাকে। কিন্তু শিশুটা কিছুটা অস্থীরতা প্রকাশ করছিলো। তাদের আসার কারণ জানতে চাইলে মা সাথে সাথে বলে উঠল তার ছেলের সব কিছুই ঠিক আছে। কেবল কথা বলে না। সবকিছু ঠিক আছে তা বলতে কি বুঝাতে চান তা জানতে চাইলে বলে যে তার জন্মের সময় কোন সমস্যা ছিলো না। সে নিয়ম মাফিক বুকের দুধ খেয়েছে, ৬ মাসে বসতে শিখেছে, ১ বছরে দাঁড়িয়েছে, দেড় বছরে হেঁটেছে অর্থাৎ তার শারীরিক বিকাশের কোন সমস্যা নেই। তবে ছেলেটি কান্নার জন্য নাক দিয়ে পানি পড়ছে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। আমার মনে হল ছেলেটির অটিজমের কিছু লক্ষণ থাকতে পারে। প্রশ্ন করতে আস্তে আস্তে এ ব্যাপারটি পরিষ্কার হতে লাগলো। শিশুটি ১৮ মাসে কিছু কথা বলেছে পরে তাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি মাবাবাকে বললাম আপনাদের শিশুর কিছু আচরণগত সমস্যা আছে। কারণ প্রথম মিটিং এ সাইকোলোজিক্যাল এ্যাসেসমেন্ট না করে অটিজম বলা মোটেই উচিত নয়। তাই তাকে মনোবিজ্ঞানীর কাছে যেতে হবে। স্পীচ থেরাপির সাহায্য নিতে হবে এবং অকুপেশনাল থেরাপির প্রয়োজন হবে। কিন্তু কক্সবাজার থেকে আসা মাবাবার কেবল ওষুধ চাই। তাদের একটিই কথা সব কিছু ঠিক আছে, শুধু কথা বলে না। যদিও মা বাবার পরিবারের দিকে ইংগিত করে বলল যে, তার শ্বাশুরির কাছে শুনেছে তার স্বামীও ছোট কালে এ ধরনের আচরণ করত। দেরীতে কথা বলেছে। আমি পরবর্তী পর্যায়ে মাবাবাকে আরো বুঝালাম যে, তার শিশুর যে সমস্যা (অটিজম কোন রোগ নয়) তা ঔষধ দিয়ে সারানো যাবে না। তবে হ্যাঁ অস্থিরতার জন্য কিছু স্বল্প ডোজে ঔষধ দেয়া যেতে পারে। শেষে তারা আমার কথায় রাজি হয়ে নন মেডিকেল ইন্টারভেনশন যেমনসাইকোলোজিক্যাল এ্যাসেসমেন্ট, স্পীচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি করাতে রাজি হয়।

এটা শুধু একটি গঠনা নয়! ২৫ বছর ধরে বিশেষায়িত শিশুর জন্য কাজ করার সুবাদে বহুবার এ ধরনের “ডিনাইল মুডে” পড়েছি। কিছু দিন আগে ঢাকা থেকেও এক দম্পতি এসেছে তাদের শিশুটিকে নিয়ে। শিশুটি মেয়ে। মা ঢাকার নব প্রতিষ্ঠিত মেট্রো রেলে কর্মরত এবং বাবা ব্যবসায়ী। ঘরে কেউ নেই। গৃহকর্মীই (মেইড) একমাত্র ভরসা। সাথে রয়েছে ডিভাইসের আসক্তি। এখানেও ঐ একই ধরনের মানসিকতা। আমি সাধারণত এ ধরনের শিশুদের মা ও শিশু হাসপাতালে অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রে ডাক্তার, মনোবিজ্ঞানী, অকুপেশনাল থেরাপিষ্ট, স্পীচ থেরাপিষ্ট সবাইকে নিয়ে মাল্টিডিসিপ্লিনারি মিটিং করি। সবাই মিলে মাবাবাকে কাউন্সিলিং করি। এতে ভাল হবার সম্ভাবনা থাকে। আমরা সবাই অবগত আছি যে, বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। ভাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে প্রসূতি পূর্ব ও প্রসূতি পরবর্তী পর্যায়ে ভাল ব্যবস্থাপনার কারণে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু শিশুর প্রতিবন্ধকতার সূচক উর্ধ্বগতির দিকে। অটিজমও এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা (গড়ৎনরফরঃু) বিশেষকরে অপরিপক্ক শিশুদের মধ্যে অটিজমের লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে। যমজ বাচ্চাদের মাঝে (সাধারণত বাচ্চারা কম ওজনের হয়) অটিজমের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কেন হচ্ছে? কি জন্য হচ্ছে? তা এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই ছোট বয়স থেকে খেয়াল রাখতে হবে এসব শিশু মায়ের চোখে চোখ রেখে তাকাচ্ছে কিনা। মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে হাসছে কিনা। বুব বুব, দাদ দাদ শব্দ করছে কিনা। কিন্তু এগুলো না করলে সে রেড ফ্ল্যাগ বা লাল পতাকার মধ্যে পড়ে যাবে। তখন প্রয়োজন সচেতনতা। মা যখন প্রসূতিকালীন চেকআপে আসে তখন আগত শিশুর আচরণ সম্পর্কেও ধারণা দিতে হবে। যাতে করে শিশু জন্ম নেওয়ার পর সে ধারনাগুলো মনে রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।

পরিশেষে ডাক্তার সমাজের দায়িত্বের কথা মনে করে দিতে চাই। চেম্বারে লম্বা সিরিয়ালের মাঝেও “কোন অসুবিধা নাই, আস্তে আস্তে কথা বলবে” এসব বাক্য ভুলানোর সুযোগ আর নাই। এতে মা বাবারা সবাই ডাক্তার সমাজকে বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করে তাদেরকে দোষারোপ করে। এ দোষারোপের সংস্কৃতি আপনার পরিবার থেকেও আসতে পারে। তখন আপনি নিজেই দায়ী থাকবেন।

 

লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র

পূর্ববর্তী নিবন্ধপটিয়াতে একুশে বইমেলা! পটিয়ার ইতিহাসে অনন্য অর্জন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে