প্রতিবছর ২ এপ্রিল সারাবিশ্বের মানুষের মধ্যে অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই দিনটিকে অটিজম দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বব্যাপী বেড়ে চলেছে অটিজম আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। অটিজম সোসাইটি আমেরিকার মতে, বিশ্বে এখন প্রতি ৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিস্টিক শিশু জন্ম নিচ্ছে। প্রতি ১১০ জন শিশুর একজন এতে ভুগছে। ছেলে শিশুদের মধ্যে অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার হার চারগুণ। নিশ্চয়ই এখন অনুভব করা যায়, কেন বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস এত গুরুত্বপূর্ণ। অটিজম আসলে কী? কেন হয়? আর হলে কী করণীয়? এ বিষয়ে আমাদের সবারই কিছু ধারণা থাকা উচিত।
অটিজম শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি সমস্যা। মাতৃগর্ভে থাকাকালে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে শিশু অটিজম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। জন্ম পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে রোগটির সব লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে শিশু স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেওয়ার পর এক থেকে দেড় বছর বয়স পর্যন্ত তেমন কোনো লক্ষণই বোঝা যায় না। সামান্য ভাষার বিকাশও হয়ে থাকে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেড় বছরের পর থেকে ভাষার বিকাশ কমতে থাকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থবহ কোনো ভাষাই আর থাকে না। অনেক সময় দেখা যায় কথা না বলা, চোখে চোখ রেখে না তাকানো, অস্থিরতা, অমনোযোগিতা, ডাকলে রেসপন্স না করা, একই ধরনের আচরণ বারবার করা, ঘুম কম হওয়া ও কারো সাথে মিশতে না পারা ইত্যাদি সমস্যাকে বাবা–মায়েরা অটিজম ভেবে ভুল করে থাকেন। তবে একটা কথা মনে রাখবেন এগুলো অটিজমের লক্ষণ হলেও অটিজম ছাড়াও অন্য কোনো নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বা অতিরিক্ত ডিভাইস নির্ভরশিলতা বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেও শিশুর মধ্যে এসব আচরণ প্রকাশ পেতে পারে। তাই সঠিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি। হতাশ না হয়ে যত দ্রুত সম্ভব অটিজম বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে তার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে।
অটিজম কাদের হয়
১. যেকোনো শিশুর অটিজম হতে পারে। ধর্ম বর্ণ আর্থসামাজিক অবস্থাভেদে যেকোনো শিশুর অটিজমের লক্ষণ দেখা দিতে পারে। ২. মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের এই জটিলতায় আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় চার গুণ বেশি। ৩. শিশুর বয়স তিন বছর হওয়ার আগেই (১৮ মাস থেকে ৩৮ মাস) এই ধরনের লক্ষণ শিশুর মধ্যে প্রকাশ পায়। ৪. বাবা মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা ও শিশুর প্রতি আচরণের ভিন্নতা অটিজমে আক্রান্ত হবার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।
অটিজম কেন হয়
এর কোন সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় বিদ্যমান রয়েছে, যেমন : জেনেটিক, মস্তিষ্কের কোনরূপ গঠনগত ক্ষতি, শরীরে নিউরো কেমিক্যাল ক্রিয়ার অসাম্য, ভ্রুণ বিকাশের সময় যদি কোন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ
১. ১২ মাস বয়সের মধ্যে শিশু আধো আধো কথা না বলা, যেমন : দা দা…., মা মা…। ২. ১৬ মাস বয়সের মধ্য একটিও অর্থপূর্ণ শব্দ না বলা। ৩. ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই শব্দের মাধ্যমে অর্থপূর্ণভাবে শব্দ বলতে না পারা। ৪. পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা না করা। ৫. ভাষা ব্যবহার রপ্ত করতে না পারা বা ভুলে যাওয়া। ৬. চোখে চোখ রেখে না তাকানো বা চোখে চোখ রেখে কথা না বলা। ৭. বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করতে না পারা। ৮. শিশুর সামাজিক সম্পর্ক কমে যাওয়া। ৯. একা একা খেলতে পছন্দ করা, কোন একটি খেলা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে খেলা। ১০. অন্য শিশুদের সাথে খেলতে না চাওয়া বা খেলনা শেয়ার করতে না চাওয়া। ১১. কথা বলা কমে যাওয়া বা হাতের ইশারায় মনের ভাব প্রকাশ করা। ১২. পুনরাবৃত্তি মূলক আচরণ করে বা কথা বলে। ১৩. সমবয়সীদের সাথে না মেশা ১৪. শব্দের প্রতি অতি সংবেদনশীলতা বা সংবেদনহীনতা। ১৫. সঠিকভাবে খেলনা ব্যবহার করতে না পারা বা খেলনা দিয়ে না খেলা। ১৬. উল্টিয়ে গাড়ির চাকা ঘোরানো। ১৬. নাম ধরে ডাকলে সাড়া না দেয়া। ১৭. বিনা কারণে হাসা বা কাঁদা।
অটিজম ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন পেশাজীবীর ভূমিকা
সাইকোলজিস্ট : একজন সাইকোলজিস্ট আপনার বাচ্চার মধ্যে অটিজম আছে কিনা তা নির্ণয় করে এবং যদি অটিজম থাকে তা কত কোন মাত্রায় আছে তা নির্ণয় করে এবং ওই অনুযায়ী পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আপনাকে যথাযথ পরামর্শ প্রদান করে থাকে।
বিহেভিয়ার থেরাপিস্ট : একজন বিহেভিয়ার থেরাপিস্ট আপনার বাচ্চার ও অপ্রত্যাশিত আচরণগুলোকে দমন করে প্রত্যাশিত আচরণ করতে সাহায্য করে। এজন্য সে অইঅ সহ বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন।
স্পিচ থেরাপিস্ট : একজন স্পিচ থেরাপিস্ট একটি শিশুকে সমাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।এক্ষেত্রে তিনি অটিজম আক্রান্ত শিশুদের সাংকেতিক ভাষা বা ছবির মাধ্যমে কথা বলা বা যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা অর্থাৎ আই কন্টাকের ব্যাপারটিও এ থেরাপির মাধ্যমে শেখানো হয়ে থাকে।
অকুপেশনাল থেরাপিস্ট : একজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট অটিজম আক্রান্ত শিশুদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করে যাতে তারা তাদের বয়স অনুযায়ী দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের নিজস্ব প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে সামর্থ্য হয়। দৈনন্দিন জীবনে কাজ কর্মের ক্ষেত্রে যাতে কোনো অসুবিধায় পড়তে না হয় সেই জন্যই মূলত এই থেরাপি দেওয়া হয়। এছাড়াও প্লে থেরাপি, ড্রাগ থেরাপি, মিউজিক থেরাপি, ইত্যাদির পদ্ধতি এখন বহু ব্যবহৃত হচ্ছে অটিজম চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।
অটিজম কখনোই ভালো হয় না। তাই কোনো একটি বিশেষ ধরনের চিকিৎসায় অটিজম নিরাময়যোগ্য– এটি এখনো পর্যন্ত কেউই দাবি করতে পারছে না। তবে আশার বিষয় হচ্ছে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও থেরাপির মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুরা অনেকটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। অনেক সময় অটিজম আক্রান্ত শিশুদের বিশেষ প্রতিভার অধিকারীও হতে দেখা যায়। এ কারণে অন্য সমস্যাগুলোর ব্যাপারে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলে পৃথিবীকে দেওয়ার মতো অনেক দক্ষতাই তাদের আছে।
পরামর্শ : শিশুকে কোনো প্রকার ডিভাইস না দেওয়া। পর্যাপ্ত সময় দেয়া। শিশুদের সাথে মুখোমুখি এবং একই লেবেলে বসে কথা বলতে হবে। সমবয়সীদের সাথে বেশি বেশি মিশতে দেয়া।
ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে শেখাতে হবে। তাদের সাথে সাধারণ কার্যক্রম করার সময় কথা বলে বলে করতে হবে। সামাজিক ভাব আদান–প্রদান করা শেখাতে হবে। শিশুর নিজস্ব কোনো প্রতিভা থাকলে সেই কাজকে সমর্থন করে প্রশিক্ষণ দেয়া। শিশুকে একটি নির্দিষ্ট নামের ঘরের বিভিন্ন দিক থেকে ডাকা। কোনো কিছু শেখানোর সময় শিশুর আগ্রহ, ইচ্ছা ও পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশুর মনোযোগ বাড়ানোর জন্য বেলুন ও বাবল ব্যবহার করা যেতে পারে। তাকে খেলার শুরু ও শেষ বোঝাতে হবে। আদান–প্রদান মূলক খেলা খেলতে হবে; যেমন : বল, গাড়ি দেওয়া–নেওয়া করা। ছবির বই দেখে ছবি চেনাতে হবে। ছড়া শোনানো, গল্প বলা। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে আনা–নেয়া করা। প্রয়োজন অনুসারে স্পিচ এবং অকুপেশনাল থেরাপি দেয়া। নিয়মিত বিশেষজ্ঞদের ফলোআপে রাখা।
লেখক : সাইকোলজিস্ট এবং সাইকোথেরাপিস্ট সিডিসি, অ্যাপোলো ইম্পেরিয়াল হাসপাতাল