অছিয়ে গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী

শায়খ মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন আযহারী | শুক্রবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

ইসলাম ধর্মে সুফিবাদ চর্চার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বহু তরিকা বিকাশ লাভ করে, যেমন : কাদেরীয়া, চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, নকশ্‌বন্দীয়া, মুজাদ্দেদীয়া ইত্যাদি। তেমনি মাইজভাণ্ডারী তরিকাও কোরআন ও হাদিসের মৌলিক ভাবাদর্শের আলোকে আলোকিত একটি অধ্যাত্ম তরিকা।

বাংলাদেশের সুফিবাদী অধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাসে মাইজভাণ্ডারী তরিকা একটি বিশেষ অধ্যায়। গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার নামক এক নিভৃত পল্লীগ্রামে মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রচারের সূচনা করেন। এই তরিকার আদর্শ ও শিক্ষা ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়েও শান্তি, সাম্য ও নৈতিকতার ভিত্তি সুদৃঢ় করার স্বভাবজাত সামর্থ সংরক্ষণ করে। মাইজভাণ্ডারী তরিকার ইতিহাসে যে কজন ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব এই তরিকার চলার পথকে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অছিয়ে গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী শীর্ষস্থানীয়।

আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সত্যকে তুলে ধরার উদগ্র বাসনা, সময়োপযোগী নির্মোহবাহুল্য বর্জিত ও যুক্তিনির্ভর লেখনি শক্তি, মাইজভাণ্ডারী আদর্শের অনুসরণে গঠিত জীবানাচার, আপোষহীন নৈতিকতা ইত্যাদি দুর্লভ গুণের সমাহার এই প্রাগ্রসর তত্ত্বজ্ঞানী হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীকে পরিণত করেছে মাইজভাণ্ডার বিষয়ক ভাবনা ও গবেষণার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। সুদীর্ঘ জীবনের পুরোটাই মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রচার ও প্রসার এবং এই তরিকার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে বিভ্রান্তি ও বিকৃতি অপনোদনের মাধ্যমে তরিকতের সঠিক আধ্যাত্মিক ধারা ও ধারণা জনসমাজে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অগ্রণীতো বটেই অনেক ক্ষেত্রে একক ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন।

জন্ম ও বংশ পরিচয় : হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩ ফাল্গুন, ১২৯৯ বাংলা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হযরত শাহ সুফি সৈয়দ ফয়জুল হক (১৮৬৫১৯০২)। তাঁর পিতামহ মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী।

শিক্ষা : তিনি পাঁচ বছর বয়সে পিতামহ হযরত গাউছুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারীর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ করেন। তিনি তৎকালীন মোহছেনিয়া মাদ্‌রাসার শেষ পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার সমাপ্তি টানেন। তবে প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডির বাইরেও বিভিন্ন বিষয়ে তার ব্যাপক পড়াশুনা অব্যাহত রাখেন।

ওফাত : তিনি ১৯৮২ সালের ১৬ জানুয়ারি, ২ মাঘ ১৩৮৮, শনিবার ইন্তেকাল করেন।

হযরত গাউছুল আজম এর স্নেহ ও ভালবাসা : তাঁকে তাঁর দাদা গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী অত্যাধিক আদর করতেন। গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী আদর করে নাতীকে ‘দেলা ময়না’, ‘দাদা ময়না’, ‘ময়না পাখি’ ইত্যাদি বলে ডাকতেন।

আধ্যাত্মিক জীবনের দীক্ষা ও উচ্চাসন : গাউছুল আজম হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী ছিলেন তাঁর পীরে তরিকত। অন্যদিকে হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী ছিলেন তাঁর পীরে তাফাইয়োজ। হযরত কেবলা ও বাবা ভাণ্ডারী এঁর ফয়েজের মিলনস্থল হিসেবে তিনি অনন্য আধ্যাত্মিক উচ্চাসনের অধিকারী।

তাঁর আধ্যাত্মিক উচ্চাসনের কথা হযরতের রহস্যপূর্ণ বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ পেতো। যেমন : ‘নবাব হামারা দেলা ময়না হ্যায়, ফের আওর কোন নবাব হ্যায়?’ ‘তোম কওন সুলতান হ্যায়? সুলতান হামারা দেলা ময়না হ্যায়?’

আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার : হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী তাঁর ওফাতের পূর্বে পুত্রবংশীয় নাতি হযরত শাহ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীকে একমাত্র উত্তরাধিকারী নির্ধারণ করে যান। তিনি বলেন, ‘‘আমার ‘দেলাময়না’ বালেগ! দেলাময়নাই আমার গদীতে বসবে।”

জাগতিক ও আধ্যাত্মিক খেদমত : হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী তাঁর উপর অর্পিত এই গাউছিয়ত ক্ষমতায় সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত হয়ে মাইজভাণ্ডারী পরিমণ্ডলে আবির্ভূত হয়েছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী মানবদরদী এক নতুন সত্তা নিয়ে। সব্যসাচীর মতো যুগপৎভাবে রূহানি হেদায়ত আর মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত অছিয়ে গাউছুল আজম স্থাপন করেছিলেন আর্তমানবতার সেবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তরিকতের কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্কুলমাদ্‌রাসালাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, ট্রেনের যাত্রীদের সুবিধার্থে স্থায়ী শেড নির্মাণ, পোস্ট অফিস স্থাপন, মাইজভাণ্ডার শরীফ ও তৎসংলগ্ন এলাকার উন্নয়ন ও বিদ্যুতায়ন, কৃষক কল্যাণের নিমিত্ত ‘সর্ত্তা লেলাং প্রবাহন এলাকা কৃষি সমিতি’ ইত্যাদি সমাজ সেবামূলক কাজ তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি নানুপুর, লেলাং প্রভৃতি ইউনিয়নের দুর্গত লোকদের জন্য কিচেন কমিটি গঠন করে খাদ্য বিতরণ করেন।

মাইজভাণ্ডারী তরিকার আধ্যাত্মিক ধারাবাহিকতা রক্ষা : হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী পীর হওয়ার জন্য খেলাফতপ্রাপ্ত হওয়ার শর্তের প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে যে ব্যক্তি আপন পীর সাহেবের কাছ থেকে সরাসরি ও স্পষ্টভাবে খেলাফত পাননি তিনি কোনোভাবেই অন্য কাউকে বায়াত দেয়ার যোগ্য নন। খেলাফত প্রদানপূর্বক সাজ্জাদানশীন মনোনয়নের মাধ্যমে গাউছিয়ত জারি রাখার নিয়মের অনুসরণে হযরত শাহ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারীও তাঁর জীবিতাবস্থায় তদীয় তৃতীয় পুত্র হযরত শাহ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারীকে নিজ গদীর উত্তরাধিকারী ও দরবারে গাউছুল আজমের সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত করে যান। তিনি শাহ সুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারীকে সাজ্জাদানশীনের দায়িত্ব অর্পণের বিষয়টি জরুরি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও তাঁর লিখিত ‘মানব সভ্যতা’ নামক বইয়ের ভূমিকাংশে উল্লেখের মাধ্যমে প্রামাণ্যকরণ করেন। তিনি জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘সৈয়দ এমদাদুল হক হানফী মজহাব সুন্নতে এজমা বিধি ফতোয়া মতে আমার মনোনীত সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত। এতদসঙ্গে আমি ঘোষণা করিতেছি যে, আমার অবর্তমানে হজরতের হুজুরা শরীফে আমার গদীর উত্তরাধিকারী বর্তমান নায়েব সাজ্জাদানশীন সৈয়দ এমদাদুল হককে আমি মনোনীত করে আমার স্থলাভিষিক্ত করিলাম। শিক্ষা দীক্ষা শজরা দান এবং ফতুহাত নিয়ন্ত্রণ অধিকার সম্পন্ন, এই গাউছিয়ত জারীসফলতাদানকারী সাব্যস্ত করিলাম।’ ‘মানব সভ্যতা’ বইয়ের ভূমিকাংশে তিনি উল্লেখ করেন, ‘অত্র বইটি আমার জীবন সায়াহ্নে ছাপাইয়া যাইতে পারিব কিনা ভবিতব্য খোদাই তাহা ভালো জানেন। তাই বইটি ছাপাইবার জন্য আমাদের প্রচলিত ‘আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী’ সমাজসংস্কার ও নৈতিক উন্নয়নমূলক সমাজ সংগঠক পদ্ধতির সফলতার উদ্দেশ্যে হানেফী মজহাব এজমা ফতোয়ার ভিত্তিতে আমি যেইভাবে কামেল অলীউল্লাহর নির্দেশিত উত্তরাধিকারী গদীর সাজ্জাদানশীন সাব্যস্ত তদ্‌মতে আমার ছেলেদের মধ্যে যোগ্যতম ব্যক্তি সৈয়দ এমদাদুল হক মিঞাকে ‘সাজ্জাদানশীন’ মনোনীত করিবার পর এই গ্রন্থটি তাহার হস্তে অর্পণ করিলাম।”

মাইজভাণ্ডারী তরিকার তাত্ত্বিক বিশ্লেষক : তিনি প্রথম পরিকল্পিতভাবে ও একাডেমিক নির্মোহ দৃষ্টিতে মাইজভাণ্ডারী তরিকার মৌলিক ভাবাদর্শ ও বৈশিষ্ট্যাবলী বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের প্রয়াস নেন। এই কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি ছোটবড় ১০ টি গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেন।

মাইজভাণ্ডারী তরিকার আদর্শ প্রচারে সাংগঠনিক ভিত্তি : মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রচার ও দাওয়াতী কার্যক্রমের উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারী’। তিনি পীরী ছায়র বা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুরিদ করানো ও হাদিয়া গ্রহণ করার প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর মতে ‘মানুষ পরিষ্কার হওয়ার জন্য পুকুরে যায়। পুকুর মানুষের কাছে আসেনা’।

নির্বিলাস জীবনাচার ও খাদেমুল ফোকরা : ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও নির্বিলাস জীবনযাপনে অভ্যস্ত। নিজের পরিচয় দেয়ার সময় তিনি অতি বিনয়ে বলতেন খাদেমুল ফোকরা বা আল্লাহর ফকিরদের সেবক। ওফাতের পরও তিনি তাঁর বিনয়ী ও নির্বিলাস সুফি দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রেখে গেছেন। তিনি তাঁর জন্য মাজার না করার এবং আলাদাভাবে কোনো ওরশ না করার জন্য ওসিয়ত করে যান। তাঁর এই অছিয়তের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর কোনো মাজার নির্মাণ করা হয়নি এবং তাঁর জন্য আলাদা কোনো ওরশের আয়োজনও করা হয়না।

লেখক : মুসলিম চ্যাপলেইন, এইচএমপিপিএস মিনিস্ট্রি অব জাস্টিজ, যুক্তরাষ্ট্র।

রিসার্চ ফেলো, দারুল ইরফান রিসার্চ ইনস্টিটিউট, E-mail: darulirfan@gmail.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধতাওবা ও ইস্তিগফার আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় এবং বান্দার গুনাহ মাফের উপায়
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা