চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের জ্যোর্তিময় পুরুষদের মধ্যে বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয় তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার জন্যে। তিনি একাধারে অগ্নিযুগের মহান বিপ্লবী, বোদ্ধা সাংবাদিক এবং ধীমান লেখক ছিলেন। প্রবীণ সাংবাদিকরা এখনো বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করবার সময় সাংবাদিকতায় তাঁর অসামান্য ভূমিকার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। লেখক বিশ্বেশ্বর চৌধুরী প্রচার বিমুখ ছিলেন। তিনি নিজেকে কখনো প্রকাশ করতে চাইতেন না। গণমাধ্যমগুলোও তাঁর ব্যাপারে উদাসীন ছিল। প্রচারে তিনি সেভাবে আসতে পারেননি বলে সাধারণজন বিশ্বেশ্বর চৌধুরী সম্পর্কে খুব কমই জানতে পেরেছে। বাংলাদেশের প্রাজ্ঞ ও দক্ষ সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম ছিলেন। তাঁর শাণিত লেখাগুলো সবসময়ই বিদগ্ধজনের কাছে সমাদৃত হয়েছে। আমরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে শুনেছি বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর বিপ্লবী জীবনের কথা। তাঁর জন্মস্থান মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামটি ব্রিটিশ আমলেই ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অনন্য অবদানের জন্য। এ গ্রামেই জন্মগ্রহণ করেছেন বিশ্ববিশ্রুত দার্শনিক এশিয়ার প্রথম ডি. লিট বেণীমাধব বড়ুয়া, জ্ঞানতাপস বীরেন্দ্রলাল মুৎসুদ্দী, সমাজ হিতৈষী সংগঠক পন্ডিতপ্রবর উমেশচন্দ্র মুৎসুদ্দী, অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদের সর্বপ্রথম সদস্য এবং বাঙালি বৌদ্ধদের মধ্যে প্রথম ব্যারিস্টার ড. অরবিন্দ বড়ুয়া, বহুগুণের অধিকারী খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী সঙ্গীতাচার্য জগদানন্দ বড়ুয়াসহ অনেক কীর্তিমান মানুষ। বিশ্বেশ্বর চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৩১৩ সালের ১৭ ভাদ্র। পিতা ডা. রমেশ চন্দ্র চেীধুরী এবং মাতা মুক্তা চৌধুরীর সন্তানদের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। অন্যান্য সন্তানরা হলেন আইনজীবী শৈলেশ্বর, গিরিবালা, ভ্রমর, ডা. ক্যাপ্টেন অমিয় চৌধুরী (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত) এবং বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর পূর্বপুরুষরা। সীতাকুন্ডের পান্থশালায় প্রথম বসতি স্থাপন করার পর বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর পূর্ব পুরুষদের একটি শাখা হাটহাজারী মির্জাপুর গ্রামে এবং অপর শাখা কোটেরপাড়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। পরবর্তী চলে আসেন রাউজানের গহিরা গ্রামে। এখানে কিছুকাল অবস্থানের পর এরা চলে আসেন পাহাড়তলীতে। এদেরই অধস্তন সপ্তম পুরুষ হলেন বিশ্বেশ্বর চৌধুরী। পাহাড়তলী নামকরণের পেছনে বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর পূর্ব পুরুষদের ভূমিকা ছিল। মহামুনি নামটি যুক্ত হয়েছিল পরে। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর পূর্ব পুরুষরা এখানকার পাহাড়ি এলাকায় বসবাস শুরু করেন। পাহাড়ি জমিগুলো ছিল তাদের দখলে। বসবাসের স্থানটি পাহাড়ের তলে ছিল বলে গ্রামটির নাম হয়ে যায় পাহাড়তলী। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর বাবা কোলকাতার ক্যাম্বেল মেডিকেল স্কুলের পাস করা ডাক্তার ছিলেন। প্রথমে তিনি জেলা বোর্ডে চাকরী করলেও পরে চাকরী ছেড়ে স্বাধীনভাবে চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। পাহাড়তলী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এবং দূরবর্তী এলাকার মানুষরাও তাঁর কাছে চিকিৎসা গ্রহণ করতে আসতো।
বিশ্বেশ্বর চৌধুরী পড়াশোনা শুরু করেন গ্রামের মডেল স্কুলে। পরে তিনি চট্টগ্রাম শহরে এসে হরিশদত্ত স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯১৭ সাণে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে আবার গ্রামে ফিরে আসতে হয়। এখানে তিমি মহামুনি এ্যাংলো পালি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আমরা তাঁর জীবনের অনেক অজানা কথা জানতে পারি “আমার কথা” বইটি হতে। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর লেখা এই বইটি প্রকাশিত হয় (১৯৯৯) তাঁর মৃত্যুর পর। প্রকাশ করেন তাঁন সহধর্মিনী শ্রীমতি রেনুকা চৌধুরী। “আমার কথায়” বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর পূর্ণাঙ্গ জীবনের কথা “জন্ম থেকে ১৯২৮” বলা হয়নি। ইচ্ছে থাকলেও সে সময় তিনি পাননি, কিন্তু এ খন্ডিত বইটিতে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর কৈশোর ও তরুণ বয়সের কথা যেমন রয়েছে এ বইটিতে তেমনি রয়েছে তাঁর বিপ্লবী জীবন এবং কর্মজীবনের কথা। এসব কথায় খুঁজে পাওয়া যাবে অজানা তথ্য। এভাবে আমরা পাবো চট্টগ্রাম শহরের তামাকুমন্ডি পাড়ার কথা। শহরে বিশ্বেশ্বর চৌধুরী যে বাসাটিতে থাকতেন সেখানে তাঁর সাথে আরো অনেকে থাকতেন। সবাই ছাত্র। তিনি তাঁর “আমার কথায়” বলেছেন, “একটা ছোটখাটো বৌদ্ধ উপনিবেশ। নয়া তামাকখোড় বড়দার উদ্যোগে আরও কয়েকজন পুলিনবাবু, অবিনাশদা, সঞ্জীবদা, নগেনবাবু সবাই তামাক ধরেছেন, বড়দা তাই পাড়ার নাম দিলেন তামাকুমন্ডি। একটি পাতলা তক্তায় আলকাতরা দিয়ে ‘তামাকুমন্ডি’ লিখে কাঠের খুঁটি লাগিয়ে পুঁতে দেওয়া হলো গলির মাথায়। সে থেকে সে পাড়াটারই নামকরণ করা হয়েছে ’তামাকুমন্ডি’। এমনকি দলিলপত্রেও” (সূত্র: আমার কথা- পৃ: ৩৬) শৈশবে বিশ্বেশ্বর চৌধুরী দুরন্ত ছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি ছিলেন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তাঁর বই পড়ার নেশা ছিল। বাড়িতে বিশ্বেশ্বর ছোটখাট একটা গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছিলেন। স্কুলের পড়ার বইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়বার দিকে তাঁর ঝোঁক বেশি ছিল। এসময় তিন রামায়ণ-মহাভারত থেকে শুরু করে বিদ্যাপতি চন্ডীদাস ইত্যাদি বই পড়া শেষ করেছেন। পড়েছেন নবীণচন্দ্র, হেমচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, ভারতচন্দ্র প্রমুখ লেখকের লেখা বইও। বাদ পড়েনি লিও টলস্টয়’র লেখা বইও। বই পড়ে তিনি ঋদ্ধ হয়েছিলেন। বড় হয়ে পড়েছেন প্রচুর মার্কসইজম এর বই। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। তিনি যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ছিলেন। শেষবর্ষে পড়াবস্থায় অসহযোগ ও লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হন। উক্ত সংবাদ লিখন ও প্রেরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তাঁর পক্ষে আর চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ছাত্র জীবনেই তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে তাঁকে দেখা যায় তাঁদের সাথে সশস্ত্র অভিযানে অংশগ্রহণ করতে। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীকে বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও করা হয়। কারারুদ্ধ ছিলেন কয়েক বছর। অবিভক্ত বাংলায় তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে আনন্দবাজার, দৈনিক কৃষক, ইত্তেফাক, ইত্তেহাদ, আজাদ, সংবাদ ইত্যাদি পত্রিকা। বিশ্বেশ্বর চৌধুরী কিছুকাল কাজ করেছেন চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী এবং ইনসাফেও। তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় কোলকাতা হতে প্রকাশিত দ্বিপাক্ষিক বাংলাভাষা পত্রিকা হতে। তিনি ছিলেন জাত সাংবাদিক। সত্যভাষণে বিশ্বেশ্বর চৌধুরী ছিলেন নির্ভীক। নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন।
এ জন্যে তাঁকে অনেকবার চাকরি ছাড়তে হয়েছে। বেকার অবস্থায় সকরুণ ছিল বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর জীবনাচরণ। তাঁর সম্পর্কে ১৯৭৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী ইত্তেফাকের উপসম্পাদকীয়; সুহৃদ, লেখা হয়েছিল. ” বিশুবাবুর কথা মনে পড়ে। একসময় ছিলেন বিপ্লবী। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের সাগরেদ।— পরবর্তীকালে আমরা তাঁহাকে দেখিয়াছি নিরেট নিরীহ সাংবাদিকরূপে। বিশ্ববাবুর কথা অনেক। কাহিনীও অশেষ। আমরা যে যুগ পার হইয়া আসিয়াছি তিনি ছিলেন সে যুগের সাংবাদিকদের অনেকটা প্রতীকরূপ।— দৈনিক ইত্তেহাদে কর্মরত ছিলেন। দৈনিক তাঁহার জন্য পাঁচ টাকা বরাদ্দ ছিল (যেন দিন মজুরী)। দিনের টাকা পাইলে চুলা জ্বলিত। অন্যথায় নিভিয়া থাকিত। সে যুগের অধিকাংশ সংবাদসেবীর ইহাই ছিল সকরুণ ইতিহাস”।—- বিশ্বেশ্বর চৌধুরী বিয়ে করেন ১৯৪০ সালের ১০ ডিসেম্বর রংপুরের গাইবান্ধার প্রবীণ বিপ্লবী ও পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেসকর্মী (জেলখানার সতীর্থ) জ্ঞানদা প্রসাদ নাগের তৃতীয় কন্যা শ্রীমতি রেনুকাকে। তিনি ছিলেন বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর সুযোগ্য সহধর্মিণী। স্বামীর বেকার অবস্থায় রেণুকা চৌধুরী সংসারের হাল ধরেছেন। সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে তাঁর অপরিসীম ভূমিকা ছিল। প্রথম জীবনে রেণুকা চৌধুরী শিক্ষকতা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে প্রশাসনিক পদে যোগদান করেন। চাকরী হতে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৮২ সালে। ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর রেণুকা চৌধুরী মৃতুবরণ করেন। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর প্রেরণার উৎস ছিলেন তাঁর সহধর্মিনী। বিশ্বেশ্বর চৌধুরী জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তার অনেক প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ্দের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটেছিল। নির্মোহভাবে তিনি তাঁদের সমালোচনা ও প্রশংসা করেছেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী ও পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর মতো বড় মাপের রাজনৈতিক নেতার কাজে ত্রুটি ধরতে ভয় পাননি। তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তা আমৃত্যু অটুট ছিল।
সাংবাদিক বিশ্বেশ্বর চৌধুরী সাত সন্তানের জনক ছিলেন। এরা হলেন শীলব্রত (প্রয়াত), অলকেশ (প্রয়াত), সুজাতা, সত্যব্রত, অরুনেশ (প্রয়াত), সুপ্রিয়া এবং সুনন্দা। জ্যেষ্ঠপুত্র কলেজ শিক্ষক শীলব্রত চৌধুরী ছিলেন একজন প্রতিভাদীপ্ত লেখক। তাঁর লেখা ‘সমুদ্রসফেন’, “রাসপুটিন” বইদুটো পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। পিতার সাথে যৌথভাবে লিখেন, ”চট্টগ্রামের ইতিহাস” বইটি। শীলব্রত ইংরেজী হতে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ছয়টি গ্রন্থ। কিন্তু তিনি লেখার ধারাবাহিততা বজায় রাখতে পেরেছিলেন না। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর মধ্যম পুত্র অলকেশ চৌধুরী “আদার কেপটিভিটি” (কানাডা হতে প্রকাশিত) বইটিতে তিনি তাঁর লেখনী শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা জীবনের ব্যস্ততার মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই লিখেছেন বিশ্বেশ্বর চৌধুরী। এর পরিচয় পাওয়া যাবে তার রচিত “টেকনাফ থেকে খাইবার”, “ব্রিটিশ ভারত ত্যাগে সিদ্ধান্ত করিলেন কেন”, “জুমিয়া জীবন”, “জীবন নদীর আকেঁবাকে”, “ভারতের দমননীতি ও সমরসজ্জা”, “পাক ভারত উপমহাদেশের বৌদ্ধ সমাজ” বইগুলোতে। বিভিন্ন সাময়িকীতে তিনি প্রচুর লিখেছেন। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আমার কথা’ বইটি। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সুনন্দার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বাঁশখালীর জলদী গ্রামের নিবেদিতপ্রাণ সমাজহিতৈষী সোমেশ চন্দ্র বড়ুয়া’র জ্যেষ্ঠপুত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি)’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া। বিশ্বেশ্বর চৌধুরী প্রয়াত হন ৪ ফাল্গুন ১৩৮৫; ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯। তিনি নিঃসন্দেহে একজন মনীষী ছিলেন। এরা অনেক সময় জীবিতকালে যথার্থভাবে মূল্যায়িত হন না। বিশ্বেশ্বর চৌধুরীর ক্ষেত্রেও এ কথাটা বলা যায়। আমার বিশ্বাস নতুন প্রজন্ম এই গুণী ব্যক্তিটিকে আবিষ্কার করতে পারবে। ইতিহাস সে কথাই বলে।
লেখক : রম্য লেখক, গ্রন্থকার ও সুসাহিত্যিক।