লেনিন : অনন্য এক দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক

মৃত্যুর শতবার্ষীকিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

কানাই দাশ | সোমবার , ১১ মার্চ, ২০২৪ at ৮:৫৮ পূর্বাহ্ণ

প্লেটো সম্ভবত বলেছিলেন King Philosopher এর কথা। তাঁর মতে একজন শাসক ও রাষ্ট্রনায়ককে অবশ্যই দার্শনিক হতে হবে। হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচলা করলে দেখা যাবে লেনিনই ছিলেন এক নতুন দুনিয়ার দার্শনিক ও বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক এই অর্থে যে তিনিই প্রথম শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণের অদৃষ্টপূর্ব কাজ শুরু করেন মার্কসীয় দর্শনের সৃজনশীল আলোতে। তাঁর বিচক্ষণ নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে সংঘটিত অক্টোবর বিপ্লব শুধু দুনিয়া কাঁপানো এক রাজনৈতিক অর্থনীতির সূচনা করেনি একজন দার্শনিক হিসাবে মানুষের চিন্তাজগতকে তিনি আলোড়িত করেছেন প্রবলভাবে। বস্তুত অক্টোবর বিপ্লব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পৃথিবী অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য ও দর্শন তথা মানুষের মনোজগতকে পরস্পর দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। এর প্রভাবে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার পতনে বদলে যায় বিশ্বমানচিত্র। কার্ল মার্কসের সুযোগ্য দার্শনিক শিষ্য হিসাবে তিনি শুধু পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেন নি প্রকৃত প্রস্তাবে পাল্টে দিয়েছেন যা বিদ্যমান সামাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরে এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদেও সমান সত্য ও প্রাসঙ্গিঁক। কেননা মানুষের অধিকারবোধ ও চেতনা লুপ্ত হয়না ক্রমে এগিয়ে যায়।

মানব কল্যাণে জীবন নিবেদিত এই দার্শনিক রাষ্ট্রনেতার ১৯২৪ সালে মাত্র ৫৪ বছরে অকালমৃত্যু রাশিয়ার তথা বিশ্ব বিপ্লবী আন্দোলনের প্রভূত ক্ষতি করে। শক্তিশালী বুর্জোয়া রাষ্ট্র সমূহের কঠোর বেষ্টনীর মধ্যেও একটি পশ্চাদপদ দেশে সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার অভূতপূর্ব প্রক্রিয়াকে তাঁর মত করে পরবর্তীতে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে টেকসই ভাবে অগ্রসর করা যায়নি। বিপ্লবী গণতন্ত্রের প্রতি আজীবন তাঁর দৃঢ় আনুগত্য এমনকি বিপ্লবের পূর্বাপর কঠিন সময়েও লক্ষ্য করা যায়। বিপ্লবের প্রস্তুতির সময় যেমন তিনি বলেছিলেন “All Power to soviets” তেমনি বিপ্লবের পরে বহির্শত্রুর আক্রমণ ও গৃহযুদ্ধের কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রতিবিপ্লব বিরোধী কিছু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিলেও পার্টির কিছু নেতার সমালোচনাকে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার পথেই মোকাবেলা করেছেন। ট্রটষ্কি, কামেনভ প্রমুখের হঠকারিতাকে তিনি তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিকভাবে জবাব দিয়েছেন। বিপ্লব পরবর্তী ‘যুদ্ধ সাম্যব্যবস্থার’ অর্থনীতি অচল হয়ে পড়লে তিনি পার্টির অনুমোদন নিয়ে ‘নিউ ইকনমিক পলিসি’ বা ‘নেপ’ ঘোষণা করেন। সহকর্মীরা অনেকেই সংশোধনবাদী বললেও তিনি এদের উত্তর দিয়েছেন ১৯২০ ও ২৩ সালে দুটো পুস্তিকা যথাক্রমে “Left wing communism an infantile disease” ও ‘‘Better fewer But Better” লিখে যেগুলো দার্শনিক প্রজ্ঞা ও মূর্ত রাজনৈতিক বোধে উদ্ভাসিত। কিন্তু তাঁর পরবর্তী নেতা স্তালিনের আমলে লেনিনের প্রায় সব নেতৃস্থানীয় সহকর্মীদের প্রতিবিপ্লবী তৎপরতার অভিয়োগে হত্যা করা হয় যখন অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অনেক শান্ত হয়ে যায়। তাঁর নেতৃত্বে লেনিনের ‘নেপ’ কর্মসূচি বাতিল করে গড়ে তোলা হয় সমাজতন্ত্রের একটি আরোপিত মডেল। সে সময় ভিন্ন স্বরের উচ্চারণ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। বিপর্যয়ের শুরু এখান থেকেই। প্রত্যেক প্রণোদনার (thrust) যেমন প্রাথমিক গতি থাকে তেমনি এই মডেল সফলভাবে অনেকদূর এগিয়েছেকিন্তু ভেতরের রক্তক্ষরণ কখনো বন্ধ হয়নি। যে কোন বিচারে লেনিন প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুতির কারনেই বিশ্বব্যাপী অনেক সদর্থক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেও বিদ্যামান সমাজতন্ত্র বিপর্যয় এড়াতে পারেনি। লেনিন জীবদ্দশায় স্তালিন নেতৃত্বের রূঢ়তা নিয়ে সতর্ক করলেও অশক্ত শরীরে কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি। ইতিহাসে তাই ব্যক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তারপরেও সবাইকে মানতে হবে যে অভ্যন্তরীন নানা সংকট সত্বেও লেনিন প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাশক্তি হিসাবে যতদিন টিকেছিল ততদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সংযত থাকতে হয়েছে। কাজেই এই সংকট থেকে মুক্তির পথ লেনিনের দর্শন ও শিক্ষার মধ্যেই নিহিত। চমর বৈরিতা উজিয়ে আজকের এই দুঃসহ অবস্থার অবসান যে অনিবার্য তাঁর দার্শনিক প্রতীতির মধ্যেই তা আমরা দেখি। তিনিই বলেছেন “Motion is the existence of matter” গতিই বস্তুর অস্তিত্বের প্রমাণ, অতএব বস্তুবিশ্বও গতিশীল এবং সেই গতি অবশ্যই প্রগতির দ্বান্দ্বিক ও সর্পিল পথে।

জার সাম্রাজ্য বিরোধী সশস্ত্র রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাল সময়ে ১৮৭০ সালে এপ্রিল মাসে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন জন্মগ্রহণ করেন রাশিয়ার উলিয়ানোভস্কের এক সমাজ সচেতন রাজনৈতিক পরিবারে। রাশিয়াতে তখন নারোদনিকদের রাজনৈতিক প্রভাব প্রবল। এদের একাংশ সশস্ত্র পথে চলতে থাকে। ১৮৮২ সালে জার আলেকজেন্ডার নিহত হলে নারোদনিকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তাঁর বড় ভাইকে অভিযুক্ত করে ফাঁসি দেয়া হয়। সারা ইউরোপে তখন শ্রমিক আন্দোলন তুঙ্গেঁ। জার্মানিতে গড়ে উঠে শ্রমজীবীদের সংগঠন কমিউনিস্ট লীগ। ১৮৪৮ সালে মার্কস ও এ্রঙ্গেঁলস যৌথভাবে সেই দলের ঘোষণাপত্র লেখেন যা পরবর্তীতে “কমিউনিস্ট ইস্তাহার” নামে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করে। মানব সভ্যতার ইতিহাস অর্থনীতি ও পরিবর্র্তনের প্রচলিত ধারনার বিপরীতে এতে বিকাশের দ্বন্দ্বমূলক গতিপথকে মানব সভ্যতার বিকাশের পথ হিসাবে তুলে ধরে প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার স্থলে শোষনমুক্ত সমাজ তথা সাম্যবাদকেই সভ্যতার নিয়তি বলে ঘোষণা করা হয়। মার্কস তাঁর বিশ্ববিখ্যাত “পুঁজি” বইতে সেই ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে মূর্ত করে তুলেন। লেনিন মার্কসএঙ্গেঁলসের রচনাবলীর নিবিষ্ট পাঠক ছিলেন এবং রাশিয়ায় তা সৃজনশীলভাবে প্রয়োগে আত্মনিয়োগ করেন। বিপ্লবের হাতিয়ার হিসাবে লেনিন সঠিকভাবেই একটি মার্কসবাদী পার্টির প্রয়োজনীয়তা বোধ করে ১৯০২ সালে তাঁর ভাষার নতুন ধরনের পার্টি ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি’ গড়ে তোলেন। প্লেখানভের নেতৃত্বে পার্টি গঠনতন্ত্রের লেনিনীয় চিন্তার বিরোধী সংখ্যলঘু অংশ মেনশেভিক নামে পরিচিত হন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক নামে খ্যাত হয়। মেনশেভিকদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এসময় তিনি লেখেন ‘কি করিতে হইবে’ নামক পুস্তিকাটি। ১৯০৫ সালে রুশ গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যর্থ হবার পরে লেনিন জারের নির্মম অত্যাচার থেকে এবং মেনশেভিকদের ভাবাদর্শিক আক্রমণ থেকে পার্টি ও মার্কসবাদকে রক্ষার জন্য ২০০৮ সালে রচনা করেন বিখ্যাত দর্শনের বই “মেটোরিয়ালিজম এন্ড ইম্পিরিও ক্রিটিসিজম”। অষ্ট্রিয় পদার্থবিদ ও দার্শনিক মাখের পজিটিভিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও মেনশেভিকদের মার্কসবাদের নামে প্রত্যক্ষ বিচারবাদ তথা সংবেদন তত্ত্ব প্রচারের প্রত্যুত্তর ছিল এই বই। তাদের মতে প্রত্যক্ষের বিচার বা সংবেদন হল দর্শনের ভিত্তি। কিন্তু লেনিন বললেন চিন্তার সাথে বস্তুর সম্পর্ক নির্ধারণই হল দর্শনের ভিত্তি। বস্তু নিরপেক্ষ সংবেদন বসু্ত সত্তার মূল নির্যাস হতে পারেনা। বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্বকে তিনি ভাববাদী প্রত্যক্ষ বিচারবাদের বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে মার্কসবাদী ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক প্রতিপাদ্যকে উর্দ্ধে তুলে ধরেন। আসন্ন সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে তিনি শান্তির সপক্ষে অবস্থান নিয়ে সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র উন্মেচন করে ১৯১৬ সালে লিখেন “সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়” নামে রাজনৈতিক অর্থনীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুস্তক। এতে তিনি দেখান যে বিংশ শতাব্দীতে এসে পুঁজিবাদী অথনীতিতে ব্যাংক পুঁজি ও শিল্প পুঁজি মিলে সৃষ্টি হয়েছে অতিকায় লগ্নীপুঁজি। এই লগ্নীপুঁজির জন্য প্রয়োজন কাঁচামাল ও নতুন বাজার। এই জন্য পৃথিবীকে নতুন করে ভাগবাটোয়ারার প্রয়োজনে এই বিশ্বযুদ্ধ। তাঁর যুদ্ধবিরোধী অবস্থান বলশেভিক পার্টিকে রুশ জনগণের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা এনে দেয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলশেভিক পার্টির সোভিয়েতগুলোর সংগ্রামী ভূমিকার কারণে পতন ঘটে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামন্তবাদী শাসন জারতন্ত্রের। কেরেনস্কির নেতৃত্বে গঠিত হয় অস্থায়ী সরকার।

লেনিন দ্রুত দেশে ফিরে বলশেভিক নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত গুলোকে বিপ্লবী অভ্যুথানের সহায়ক শক্তি হিসাবে গড়ে তোলার উপর জোর দেয়ার পাশাপাশি বলশেভিক পার্টিকে শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির উপর দাঁড় করান। পার্টির এপ্রিল মাসে আয়োজিত বৈঠকে তিনি ফেব্রুয়ারির গণ অভ্যুত্থানকে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যাখ্যা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেন। তিনি বলেন রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে উন্নীত হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াদের দ্বারা গণতান্ত্রিক কর্তব্য সম্পন্ন করা যাবেনা। পার্টি নেতৃত্বের একাংশের বিরোধিতা সত্বেও তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয় যা বিখ্যাত ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে খ্যাত। এই সিদ্ধান্তের আলোকে প্রধানত শ্রমিকও সৈনিকদের সোভিয়েতগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহনে বড় কোন বাধা ছাড়াই বলশেভিক পার্টি অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত করে। বিপ্লবের পর দেশের ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীলরা সশস্ত্র বিদ্রোহ করে এবং ১৪টি পুঁজিবাদী দেশ একসাথে রাশিয়া আক্রমণ করে। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ এড়িয়ে অবশেষে ১৯২১ সালে বলশেভিকরা গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। গঠিত হয় বিশাল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া এবং পাটির নেতৃত্বের একটি বড় অংশের বৈরিতাকে মোকাবেলা করে তিনি অর্থনীতিতে সংস্কার নীতি বাস্তবায়ন করে দৃঢ়ভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সাধনে এগিয়ে যান। এ সময় পার্টি নেতৃত্বেরও তিনি সমালোচনা করেন এবং একাংশের বাম হঠকারী ও অন্য অংশের অনমনীয় নির্দয় রূঢ়তার জন্য। তিনি বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে এজন্য আশংকা ব্যক্ত করেন। ১৯২৪ সালে তাঁর মৃত্যু ঐ আশংকাকে সত্য প্রমাণিত করে।

একজন দার্শনিক ও বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে তাঁর প্রয়োগিক চিন্তাধারা মার্কসীয় ভাবনাকে ঋদ্ধ করেছে। মূর্ত পরিস্থিতিতে মূর্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত তাঁর অসাধারণ বইগুলোই হল মার্কসীয় চিন্তার বিকশিত রূপ যা ‘লেনিনবাদ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ বানার্ড’শ এর ভাষায় ‘লেনিন’ মানে অতীত নয় লেনিন মানে ভবিষ্যৎ’। আজকের এই বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়ার নজিরবিহীন উত্থানের প্রেক্ষিতে এবং আমাদের দেশে রাজনীতিতে দর্শনের প্রকট দারিদ্র্যের মধ্যে এই কথা অনেক বেশি সত্য ও প্রাসঙ্গিক।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘জ্ঞান চৌতিশা’র কবি আশক্ল্লর আলী পণ্ডিত
পরবর্তী নিবন্ধসিবিইউএফটি’তে চিত্র প্রদর্শনী ও পিঠা উৎসব