নগরে ছোট-বড় ৫৭টি খাল আছে। এর বাইরে ৯৭২ কিলোমিটার নালা-নর্দমা আছে। বেশিরভাগ খাল-নালা বর্জ্য-আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। সেখানে বদ্ধ পানিতে বাড়ছে মশার লার্ভা। এদিকে ঘনিয়ে আসছে বর্ষাকাল। খাল-নালা পরিষ্কার না থাকায় বাড়ছে জলাবদ্ধতার শঙ্কাও। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ বাস্তবায়ন করছে ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মেগা প্রকল্প। প্রকল্পটির পরিচালক জানিয়েছেন, বর্তমানে খালে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ চলছে। সেজন্য কোথাও কোথাও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। আগামী মে মাসের শেষের দিক থেকে বাঁধ অপসারণ করে খনন কাজ শুরু করা হবে।
অতীতে বর্ষাকে সামনে রেখে শহরের খাল-নালাগুলো নিয়মিত খনন করত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে সিডিএ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে জিও পেলে তিন ফুটের অধিক প্রশস্ত খাল-নালা খনন কার্যক্রম স্থগিত করে চসিক। সংস্থাটির দাবি, তিন ফুটের অধিক প্রশস্ত ড্রেন-নালাগুলোও মেগা প্রকল্পভুক্ত। সর্বশেষ মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নির্দেশে তিন বছর পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি খাল-নালা থেকে ময়লা অপসারণ শুরু করে চসিক। এতে অর্থ ‘অপচয়’-এর পাশাপাশি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ‘ওভারলেপিং’ হওয়ার। বিষয়টি নিয়ে মেয়রও চিন্তিত।
এ অবস্থায় সিডিএর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিতে উদ্যোগ নেন তিনি। এর অংশ হিসেবে মেগা প্রকল্প নিয়ে আজ রোববার দুই সংস্থার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এতে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ও মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী উপস্থিত থাকবেন।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, মেগা প্রকল্পের আওতায় রিটেইনিং ওয়াল ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সুবিধার্থে শহরের গুরুত্বপূর্ণ খালগুলোতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে পানি চলাচল করছে না। ফলে জমাটবদ্ধ স্থির পানি হয়ে উঠেছে মশা প্রজননের প্রধান স্থান। কোথায় কোথায় এ ধরনের বাঁধ আছে তার একটি তালিকা আজকের বৈঠকে তুলে ধরবে চসিক। একইসঙ্গে দ্রুত বাঁধগুলো অপসারণের প্রস্তাব দেবে।
চসিকের দায়িত্বশীলরা মনে করেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও খাল-নালা থেকে বর্জ্য অপসারণে নিজস্ব জনবল ও ইকুইপমেন্ট নেই সিডিএর। বিপরীতে জনবল ও যন্ত্রপাতি উভয়ই আছে চসিকের। তবে আর্থিক সংকট আছে। আবার প্রকল্পভুক্ত এলাকায় কাজ করারও এখতিয়ার নেই। এ অবস্থায় আজকের বৈঠকে খাল থেকে ময়লা-আর্বজনা অপসারণে মেগা প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হবে চসিকের পক্ষে।
২০১৯ সালে চসিকের সঙ্গে সমন্বয় করে মেগা প্রকল্পের আওতায় শহরের ওয়ার্ডভিত্তিক ছোট আকারের ২৪০ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার করা হয়েছিল। ওই বছরের মে মাসে চসিকের পক্ষ থেকে ২৪টি ওয়ার্ডের ৪৯৮টি খাল-নালা ও ড্রেনের তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছিল মেগা প্রকল্প পরিচালকের কাছে। স্থানীয় কাউন্সিলরগণ তালিকটি প্রস্তুত করেছিলেন। এর আগে সমন্বয় নিশ্চিতে একই বছরের এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তৎকালীন মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী কাউন্সিলরদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছিলেন। ২০২০ সালে সমন্বয় ছিল না দুই সংস্থার।
চসিকের একাধিক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, মেগা প্রকল্পের আওতায় চলতি বছর আসন্ন বর্ষাকে সামনে রেখে খাল-নালা থেকে ময়লা-আর্বজনা অপসারণ করা হয়নি। মেয়রের ঘোষিত একশ দিনের কর্মসূচির আওতায় চসিক বিভিন্ন খাল থেকে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মাজার গেট সংলগ্ন কৃষি খাল, বীর্জা খাল, বহদ্দারহাট থেকে শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত নালা, ডোমখাল, কাজীরহাট খাল, খেজুরতলা পাঠানটুলী খাল, সৈয়দ শাহ খাল, মহেশখালের পূর্ব নিমতলা ও ফকিরহাট, আমবাগান রোড সংলগ্ন্ন খাল, চশমা খালের দুই নম্বর থেকে ভূমি অফিস পর্যন্ত অংশে চসিক স্কেভেটর দিয়ে পরিষ্কার করেছে বলে আজাদীকে জানিয়েছেন সংস্থাটির অতিরিক্ত প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. মোরশেদুল আলম চৌধুরী।
মেয়রের বক্তব্য : সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে খাল-নালায় বাঁধ দিয়েছে। এতে পানি যেতে পারছে না। জমাট হয়ে আছে। সেখানে লার্ভা সৃষ্টি হচ্ছে আর শহরে মশা বেড়েছে। কিন্ত লোকজন তো আমাদের ভুল বুঝছে। যেহেতু বর্ষা আসছে বাঁধগুলো অবশ্যই খুলে দিতে হবে। অন্যথায় মানুষ কষ্ট পাবে।
মেয়র বলেন, তিন ফুটের বেশি খাল-নালা পরিষ্কার করতে হবে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে। এরপরও মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা প্রায় এক মাস ধরে পরিষ্কার করছি। কিন্তু এসব করার জন্য সরকার মেগা প্রকল্পে অর্থ দিয়েছে। একই কাজ আমরাও করলাম, তারাও করল। এক কাজের জন্য সরকারের দুই সংস্থার টাকা খরচ হবে কেন? এখন তারা বললে আমরা ইকুইপমেন্ট ও জনবল দিয়ে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি। সমন্বয় করে করলে কাজটা সুন্দর হবে। এক কাজ বারবার করতে হবে না এবং জনগণ উপকৃত হবে।
মেগা প্রকল্প পরিচালক যা বললেন : মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী আজাদীকে বলেন, সব জায়গায় কাজ চলমান আছে। ইনশাল্লাহ নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার চেষ্টা করছি। বর্তমানে রিটেইনিং ওয়ালের কাজ করছি। এজন্য খালের মাঝখানে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। এতে মনে হচ্ছে খাল ভরাট হয়ে আছে। কিন্তু সেগুলো থাকবে না। এপ্রিল-মে মাস পর্যন্ত তো হালকা বৃষ্টি হবে। এরপর যখন ভারী বৃষ্টি হবে তখন আমরা রাস্তাগুলো খুলে দেব। তার আগ পর্যন্ত এভাবে কাজ করে যেতে হবে। মে মাসের শেষের দিকেই খুলে দেব।
তিনি বলেন, সবগুলো খালের পানি কিন্তু একদম বন্ধ করিনি। একেবারে বন্ধ আছে চশমা খালের মুরাদপুরে। বাকি জায়গায় বন্ধ মনে হলেও পাইপের মাধ্যমে পানি যাচ্ছে।
বর্তমানে কোন কোন খালে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজাখালী খাল-২ পুরোপুরি হয়ে গেছে। দ্রুত সময়ে শেষ হবে সদরঘাট খাল ১ ও ২, রাজাখালী খাল-১ ও ৩, টেকপাড়া খালসহ আরো বেশ কয়েকটি খাল।
খাল খনন প্রসঙ্গে বলেন, এখন আমরা খনন করব না। রিটেইনিং ওয়ালের কাজ শেষে একেবারে ক্লিয়ার করব। এখন করলে কয়দিন পর আবার ভরাট হয়ে যাবে। এ বছর বারবার করব না। এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে জানান তিনি।