‘ডেঙ্গু থাকছে সারা বছর, বাঁচতে দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা’

| শনিবার , ২৪ জুন, ২০২৩ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

বর্ষাকালকে বলা হয় ডেঙ্গুর মৌসুম, কিন্তু বাংলাদেশে এখন সেই বাস্তবতা বদলেছে। জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিণত হয়েছে সারা বছরের রোগে। কেবল তাই নয়, ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকলেও এখন রোগী পাওয়া যাচ্ছে সারা দেশে; নগরায়ণের ফলে গ্রামও মশাবাহিত রোগের ঝুঁকির বাইরে থাকছে না।

ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। এ মশার বিস্তারের প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে যে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যাপকতা পেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন কবিরুল বাশার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এডিস মশা এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনা, যাতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার’ বিষয়টিও থাকতে হবে। খবর বিডিনিউজের।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত বছর ৬২ হাজার ৩৮২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন; তাদের মধ্যে রেকর্ড ২৮১ জনের মৃত্যু হয়। তার আগে ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলায় এক লাখের বেশি মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। সরকারি হিসাবে সে বছর মৃত্যু হয়েছিল ১৬৪ জনের। এ বছর বর্ষার শুরুতেই আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ২৯৩ জনে পৌঁছেছে, মৃত্যু হয়েছে মোট ৩৯ জনের।

ডেঙ্গুর সময় বাড়ল কেন : জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে, তাই বর্ষাকালকেই বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হত এতদিন। আগে শীতকালে রোগী পাওয়া যেত না সেভাবে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শীতকালেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে বলে জানালেন অধ্যাপক কবিরুল। ঢাকা শহরে মাঠ জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, শুধু বৃষ্টির পানি জমে এডিস মশার প্রজনন হচ্ছে, এ অবস্থা আর নেই। কারণ নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারিএ চার মাস বলা যায় দেশে একদমই বৃষ্টি হয় না। অথচ এবছরের শুরুর দিকেও এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাওয়া গেছে।

মশা নিয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা এই গবেষক বলেন, ডেঙ্গু জ্বর এখন সারা বছরের বিষয় হয়ে গেছে। এর কারণও আছে। ঢাকা শহরে নগরায়নের পরিবর্তন হয়েছে। অনেক বহুতল ভবন তৈরি হয়েছে। বেজমেন্টে গাড়ি রাখার জায়গা করা হয়েছে। সেখানে গাড়ি ধোয়াও হয়। বেজমেন্টে তাই পানি জমে থাকে। এমন জায়গায় এইডিস মশাও পাওয়া গেছে। আবার পানির সংকটের কারণে নগরবাসী ড্রামে, বালতিতে পানি জমিয়ে রাখে। এসব জমা পানিও এডিস মশার প্রজননস্থল। এগুলোর সঙ্গে বৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বৃষ্টির মৌসুম ছাড়াও আমাদের দেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে।

গ্রামেও ডেঙ্গুর ঝুঁকি : কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলছেন, ২০১৯ সালে দেশের ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল। এ বছরও পুরো দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়তে পারে। গ্রামও যে ঝুঁকির বাইরে নয়, সে কথা জানিয়ে তিনি বলেন, নগরায়ন হচ্ছে প্রতিটি জেলায়। এর সঙ্গে এডিস মশার একটি সম্পর্ক আছে। যেখানে নগরায়ন হয়, সেখানেই এডিস ইজিপটাই, এই মশা বাড়তে থাকে।

ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কোনো বছর কম থাকছে, আবার কোনো বছর বেড়ে যাচ্ছে। এটাই এ ভাইরাসের ধরণ বলে জানালেন গবেষক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এটা অনেকটা ঢেউয়ের তালে চলে। ২০২০ সালে কম ছিল, পরের বছর বেড়েছে, ২০২২ সালে আরো কিছুটা বেশি ছিল। এ বছর মাঠপর্যায়ের তথ্যউপাত্ত থেকে আমরা যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করছি, সেখানে যা দেখতে পাচ্ছি, যদি আমরা এখনি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি, এবছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি বেশ খারাপ হবে।

নিদান কী : কবিরুল বাশার বলেন, যদি আমরা এডিস মশা এবং ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে আমাদের ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এই মহাপরিকল্পনার মধ্যে থাকবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। একটি মহাপরিকল্পনা যদি এডিস মশা ও কিউলেঙ মশার জন্য আলাদা আলাদা ১০ বছর ধরে চালাতে পারি, তাহলে হয়তো ধীরে ধীরে মশা ও ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। তাছাড়া এটি বেশ কঠিন।

নাগরিকরা কতটা সচেতন : আর সব বিশেষজ্ঞের মত ড. কবিরুল বাশারও বলছেন, এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সরকার, রাষ্ট্র, সিটি করপোশেন বা কারো একার পক্ষে সম্ভব না। সেজন্য দরকার জনসচেতনতা। কারণ এডিস মশা বাড়িতে, বাড়ির আঙিনায় বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে হয়। যাতে পানি না জমতে পারে, সেই দায়িত্ব নাগরিকদেরই পালন করতে হবে। সিটি করপোশেনের জায়গা থেকে সিটি করপোরেশন, নগরবাসীর জায়গা থেকে নগরবাসী সমন্বিতভাবে কাজ করবে। আর তখনি বাংলাদেশ ডেঙ্গু বা এডিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

. কবিরুল বাশার বলেন, একজন গবেষক হিসেবে আমরা যা বলি, সেটা হচ্ছে ইন্টিগ্রেটেড মসকিটো ম্যানেজমেন্ট। এরমধ্যে চারটা কম্পোনেন্ট থাকে। একটি হচ্ছে পরিবশেগত ব্যবস্থাপনা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, মশা যে পরিবেশে হচ্ছে, সেই পরিবেশ পরিবর্তন করে দিতে হবে। একটি পাত্রে পানি জমা থাকলে মশা হয়, সেই পাত্রটি যদি উল্টে রাখি, তাহলে আর মশা হচ্ছে না। একটি ড্রেন আটকে গেলে সেখানে কিউলেঙ মশা হচ্ছে। ড্রেনটা যেন আটকে না যায়, চলমান থাকেসে ব্যবস্থা নেওয়া পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা। দ্বিতীয় পয়েন্ট হল অন্য জীব দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ। যেমন গাপ্পি ফিশ দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ। অথবা ছোটবড় যে ড্রাগন ফ্লাই, বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় আমাদের দেশে ছিল, সেই পোকামাকড়গুলো মশা খেয়ে জীবযাপন করে। এই পোকামাকড়ের ভারস্যাম্যটা পৃথিবীতে রাখা, বাংলাদেশে রাখাএটা হচ্ছে জীবজ নিয়ন্ত্রণ। এরপর তিন নম্বরে আসছে কীটনাশক। যদি আমরা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হই, আমরা যদি জীবজ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হই, তিন নম্বরে গিয়ে আমাদের কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। আর চার নম্বর হচ্ছে জনগণকে সম্পৃক্ত করা। তার মানে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, জীবজ নিয়ন্ত্রণ, কীটনাশক দ্বারা নিয়ন্ত্রণ এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করাএই চারটি কম্পোন্টে যদি আমরা একসাথে চালাতে পারি, তাকে বলা হয় সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। আর এ সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ যদি আমরা করতে পারি, তাহলেই আমরা মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। শুধুমাত্র কীটনাশক দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করাটা আমি মনে করি ব্যর্থ চেষ্টা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটাইটানে ঠিক কী ঘটেছিল, জানা যাবে কীভাবে
পরবর্তী নিবন্ধঅন্তর্মুখী বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে যায় টাইটান