জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১০ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে হিংসা বিদ্বেষের ভয়াবহ পরিণাম

পবিত্র কুরআনে হিংসা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ: কাউকে হিংসা বিদ্বেষ করা, কারো প্রতি শত্রুতা পোষণ করা, কোনো মানুষের সুখ শান্তি উন্নতি সহ্য করতে না পেয়ে তার ক্ষতি, ধ্বংস ও অকল্যাণ কামনা করার নাম হিংসা বিদ্বেষ। এটি এক প্রকার নিকৃষ্ট কাজ। হিংসুক লোকেরা সবসময় নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে তুচ্ছ ও নগন্য মনে করে সম্মানিত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতা স্বীকার করতে চায় না। এ শ্রেণির মন্দ প্রকৃতির হিংসুকের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ তা’আলা নির্দেশ দিয়েছেন। এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে (আশ্রয় চাই) যখন সে হিংসা করে। (সূরা: ফালাক, আয়াত: ১১৩:)

আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত বান্দাদেরকে হিংসা করা হয়: আল্লাহ তা’আলা তাঁর বান্দাকে অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন, মানুষের ধনসম্পদ, মানসম্মান, যশখ্যাতি, পদপদবী, যোগ্যতা, দক্ষতা, পার্থিব জীবনের সবকিছুই আল্লাহ প্রদত্ত। হিংসুক লোকেরা আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের নিয়ামত সহ্য করতে না পেরে মানুষের প্রতি হিংসা বিদ্বেষ চরিতার্থ করে কুৎসা রটনা করে, পরনিন্দা ও দোষ চর্চা করে বেড়ায়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদের ঈর্ষা করে।” (সূরা: নিসা, আয়াত: ৩৪)

হাদীস শরীফের আলোকে হিংসুকের ভয়াবহ পরিণতি: কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ করা হারাম ও কবীরা গুণাহ, পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর অসংখ্য স্থানে এর মারাত্নক ভয়াবহ পরিণতি আলোকপাত হয়েছে। হিংসুকের নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দানসাদকা ইবাদত বন্দেগী সর্ব প্রকার নেক আমল সমূহ হিংসার কারনে নি:শেষ হয়ে যায়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সাবধান! হিংসা করা থেকে বেচে থাকবে। কারণ হিংসা যাবতীয় নেক আমল খেয়ে নি:শেষ করে যেমন আগুন লাকড়ীকে নিঃশেষ করে দেয়। (সুনান আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ, পৃ: ৩২০)

হিংসুক ব্যক্তি হিংসার আগুনে জ্বলে বিভিন্ন ভাবে অন্যের ক্ষতি সাধনে উদ্যত হয় ও তৎপর থাকে। হিংসুক ব্যক্তি বিভিন্ন কারনে হিংসা করে সে অপরের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি অর্জন সহ্য করেনা। হিংসুক ব্যক্তি নিজের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার করতে না পেরে ক্ষেত্র বিশেষে অন্য মানুষকে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না, বংশগত নীচুতা, সংকীর্ণতা, শটতা, কপটতা, অন্য জনের ধন সম্পদ সহ্য করতে না পেরে সর্বদা মানসিক যন্ত্রণায় অস্থির থাকে।

হিংসুক দ্বীনের মূলচ্ছেদকারী: হিংসা মানুষের তাকওয়া বিনষ্টকারী নিন্দনীয় কাজ। হিংসা বিদ্বেষের ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিবর্গ জীবনে সূখী হতে পারেনা। সর্বদা মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। সে সামাজিক ভাবে ঘৃণিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত যুবায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে বিস্তার লাভ করবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের নৈতিক ব্যাধি। আর তা হলো হিংসা ও বিদ্বেষ। এটি হলো মুন্ডনকারী, আমি চুল ন্যাড়া করে মাথা মুন্ডানের কথা বলছিনা বরং এর দ্বারা দ্বীন মুন্ডন বা মূলোচ্ছেদ হওয়ার কথা বুঝাচ্ছি। (জামি তিরমিযী, মিশকাত, পৃ: ৪২৮)

পূর্ববর্তী উম্মতদের ব্যাধি: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শীঘ্রই আমার উম্মতের মাঝে পূর্ববর্তী উম্মতদের ব্যাধি পৌঁছে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন এয়া রাসূলাল্লাহ! পূর্ববর্তী উম্মতদের ব্যাধি কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, . অহংকার, . অধিক সম্পদ অর্জনের মোহ, . পারস্পরিক দূরত্ব, . হিংসা করা। (আল মুস্তাদরেক লিল হাকেম, খন্ড:, পৃ: ১৬৮, ইয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড: , পৃ: ৪২২)

হিংসুক আল্লাহর বণ্টনে অসন্তুষ্ট: ইমাম গাজ্জালী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, হিংসুক আমার নিয়ামতের শত্রু। আমার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট, আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যে বণ্টন করেছি হিংসুক আমার বণ্টনে অসন্তুষ্ট। (ইয়াহিয়াউলুম, খন্ড: , পৃ: ৪২২)

হিংসামুক্ত মানুষ আল্লাহর আরশের ছায়াতলে থাকবে: হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী (.) বর্ণনা করেন, হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এক ব্যক্তিকে আরশে আযীমের ছায়াতলে দেখলেন, লোকটির এমন মর্যাদা দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে হযরত মুসা (🙂 আল্লাহ তা’আলার নিকট জিজ্ঞেস করলেন, কোন নেক আমলের কারণে লোকটি এমন মর্যাদা প্রাপ্ত হয়েছেন, তখন আল্লাহ তা’আলা লোকটির তিনটি নেক আমলের কথা জানালেন। ১. আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে দান করেন লোকটি হিংসা করেনা, . লোকটি নিজ পিতা মাতার সাথে অসদাচরণ করেননি, . লোকটি কখনো কারো বিরুদ্ধে চোগলখুরী করেনি, (ইয়াহিয়া উল উলুম, খন্ড: , পৃ: ৪২২)

সর্ব প্রথম হিংসুক ইবলিস: হযরত ইমাম গাজ্জালী (.) বর্ণনা করেন, সর্ব প্রথম গুণাহ হিংসা করা। অভিশপ্ত ইবলিস হযরত আদম (.)’র সম্মান ও মর্যাদার কারণে তাঁর প্রতি হিংসা বশত: সিজদা করতে অস্বীকার করেছে। (প্রাগুক্ত, পৃ: ৪২৩)

ভাইয়ের সাথে হিংসা: যরত ইমাম গাজ্জালী (.) বর্ণনা করেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম’র পুত্র কাবিল আপন ভাই হাবিলকে হিংসার কারণে হত্যা করেছে। (আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড: , পৃ: ৬২৫)

পবিত্র কুরআনে সূরা ইউসূফে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইউসূফ (.)’র ভ্রাতাগণ হযরত ইউসূফ (:)’র সাথে হিংসা করেছে, হিংসার কারণ ছিলো হযরত ইয়াকুব (.) হযরত ইউসূফ (🙂 কে বেশী ভালবাসতেন। এ কারণে অন্য ভাইয়েরা ইউসূফ (🙂 কে হত্যা করতে চেয়েছে (ইয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড:, পৃ: ৫২৭)

পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষ মু’মিনের চরিত্র নয়: মুমিনের আদর্শিক গুণাবলী তাঁর জীবনকে সৌন্দর্য মন্ডিত করে, পক্ষান্তরে মন্দ স্বভাব বান্দার চরিত্র কলুষিত করে। মুসলমান কখনো কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থি গর্হিত আচরণে লিপ্ত থাকতে পারেনা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছ, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা মিথ্যা ধারণা পোষণ করা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা মিথ্যা ধারণা করা নিকৃষ্ট মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত। তোমরা গোয়েন্দাগিরি করোনা, কারো দোষ খুঁজে বেড়াইওনা, তোমরা ছিদ্রান্বেষণ করোনা। অপরের পশ্চাদ্বাবন করোনা, পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষে লিপ্ত হয়োনা, তোমরা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক পরস্পর ভাই ভাই হয়ে আল্লাহর বান্দা হয়ে যাও, মুসলমান মুসলমানের ভাই, সে তার উপর না অত্যচার করে আর না তাকে অপমান করে। না তাকে হীন মনে করে। কোনো ব্যক্তি মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে হীন মনে করবে। এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের সম্পদ তার রক্ত ও সম্মান পবিত্র বলে বিবেচিত। (বুখারী, খন্ড:, পৃ: ৭৭৯, আলআদাবুল মুফরাদ, পৃ: ১৯৯৯)। মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র শবে বরাতের মহান শিক্ষা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবতার উপর জুলুম : সার্বত্রিক ধ্বংসের মূল কারণ
পরবর্তী নিবন্ধকানুনগোপাড়া বসন্ত নাট্য উৎসব ও একজন বন চৌধুরী