চট্টগ্রামের প্রতি ওদের ভালোবাসা নেই
অনেক দিন হয়ে গিয়েছে ‘আমার দেশ আমার শহর’ কলামটি লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ হৃদয়ের মধ্যে বিক্ষুব্ধ হওয়ার ঝড় বইছে তাই কলম হাতে লিখতে বসেছি। বাংলাদেশ আমার দেশ। চট্টগ্রাম আমার প্রিয় শহর, আমার জন্মভূমি। পৃথিবীর উন্নত দেশের জৌলুস এবং মনোরম পরিবেশ দেখেও আমি সেসব দেশের প্রতি মমতা অনুভব করিনি। কিন্তু চট্টগ্রামের জন্য আমার অন্তরে রয়েছে গভীর ভালবাসা। চট্টগ্রাম এক সময় ছিল বাংলাদেশের তিলোত্তমা শহর, রূপসী নগরী, বৃটিশ আমল থেকেই চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সমুদ্র বন্দরের জন্য বিখ্যাত ছিল। কলকাতার ইতিহাস থেকে জানা যায় জব চার্নক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী হুগলি থেকে সরিয়ে চট্টগ্রামে আনতে যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রাম উপকূলে পৌঁছার আগেই তার সব জাহাজ নবাবের সৈন্য দখল করে নেয়। তখন জব চার্নক কাসিম থেকে ২৭ মাইল ভাটিতে সূতানটি ও হিজলি গ্রামে ব্যবসার ঘাঁটি গড়েন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২৫শে মার্চের আগেই সমুদ্র বন্দরে যুদ্ধজাহাজ থেকে অস্ত্র না নামিয়ে চট্টগ্রামবাসী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। ২৫শে মার্চের পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করে সারা দেশের মানুষের মনের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত করে তুলেছিল। বৃটিশ আমলে স্বাধীনতার সৈনিক সূর্যসেন, প্রীতিলতা, কল্পনা সবাই স্বাধীনতার পথের অগ্রসৈনিক। তাই চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতার যাত্রাপথ শুরু। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর তাতে কোন সন্দেহ নেই।
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরূপ। চট্টগ্রামের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভার ছটায় মানুষ মুগ্ধ হতো। চট্টগ্রাম নগরীর সৌন্দর্য বাংলাদেশের সরকারি অথবা বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি। চট্টগ্রাম শহরের মনলোভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছিল নিজস্ব সহজাত শ্যামল পরিবেশ। ঘন সবুজ গাছপালা, পান্না রঙের সারি সারি নাতিদীর্ঘ শ্যামল পাহাড়ের সমন্বয়ে চট্টগ্রামের সৌন্দর্য গড়ে উঠেছিল। এ যুগের ছেলে মেয়েরা চিন্তা করতে পারবে না কি অপূর্ব শোভা ছিল চট্টগ্রাম শহরের সর্বত্র। জিইসি রোড থেকে আরাকান রোড পর্যন্ত দু’পাশে গাঢ় শ্যামল গাছপালা ঘেরা ঘন সবুজ ছোট ছোট পাহাড়। দূরে ফয়’স লেকের যাবার পথের দু’ধারে পাহাড়ে পাহাড়ে সবুজের সমারোহ। ফয়’স লেকের স্বচ্ছ টলমলে পানির ধারে, নিবিড় গাছপালার ছায়ায়, ঝিরঝিরে হাওয়ায় বসে অনাবিল সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যেতো। ফয়ে’স লেক যাবার পথে শ্যামল পাহাড়ের ওপর উঠলে শহরের অনেক খানি দৃশ্য দেখা যেতো। পাহাড়ের মাঝখানে একটি ছোট দীঘির মত জলের আধার ছিল। আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ, কমলা রঙের রোদের আভা, নীল দিগন্ত, সবুজ পাহাড়ের সীমানায় চট্টগ্রামের অপূর্ব সৌন্দর্য আমাদের মনে বিমুগ্ধতা ছড়াতো, আমরা বলতাম “সুইজারল্যান্ড”।
সবুজ পাহাড়ের পাশে কত ছবি তুলেছি। পাকা সংকীর্ণ মসৃণ রাস্তা এঁেকবেঁকে চলে গিয়েছে অফুরন্ত গাছপালার মধ্য দিয়ে সুদূরের পানে। আজ সে সব পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকার ভীড়ে। ওআর নিজাম রোড, ওয়ার সিমেট্রির রাস্তার দু’পাশে ছিল বড় বড় গাছপালা ও গাঢ় শ্যামল পরিবেশ। চট্টগ্রাম সরকারি গার্লস কলেজে পড়তে যেতাম সারি সারি পাহাড়ের মধ্য দিয়ে মসৃণ রাস্তা পাড়ি দিয়ে। চারদিকের শোভা দেখতে দেখতে রাস্তা পার হয়ে যেতো কখন তা খেয়াল থাকতো না।
চট্টগ্রাম রেলওয়ের কার্যালয় অথবা সিআরবি-এর চারপাশে সবুজ পাহাড়, দীর্ঘ বিশাল গাছপালা ও ফাঁকা মনোরম পরিবেশ আজও চট্টগ্রামবাসীর প্রিয় স্থান। বড় বড় দীঘল বিশাল গাছগুলো দেখে মন বিস্ময়ে সীমা হারায়। এত সুন্দর! শীতকালে শিশিরের আগমনে পাতার ওপর রোদ পড়ে রূপার মত ঝিকমিক করে। বর্ষাকালে গাছের পাতায় রিমঝিম বৃষ্টি শব্দের ঝংকার তুলে গড়িয়ে পড়ে। বসন্তে দখিনা বাতাসে শিরীষ গাছের পাতার শির শির মিষ্টি শব্দ, কখনো হঠাৎ গরমে দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছোট ছোট পাখির শিস মনের মাঝে অসীমের সুর ধ্বনিত করে। চট্টগ্রাম শহরের সুউচ্চ অট্টালিকার মাঝে অল্প একটুকু ফাঁকা জায়গা, শ্যামল পরিবেশ। তাই নববর্ষে অথবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মানুষ এসে ভীড় জমায়। পথচারীরা প্রায়ই এখানে ঘুরে বেড়ায়। কিছুক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক শোভা দর্শন করে হৃদয়ে অনাবিল আনন্দের স্বাদ অনুভব করে। গাছপালা, পাহাড় এবং প্রাকৃতিক রূপসুধা পান করলে মনের গুরুভার লাঘব হয়, প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা জন্মে। এ স্থানটি বৃটিশ আমলে ইংরেজ শাসক তৈরি করেছিল, এমন নান্দনিক পরিবেশ। চট্টগ্রামের কোনো নেতা অথবা কর্মকর্তা আজ পর্যন্ত চট্টগ্রামে এরকম সুন্দর পরিবেশসহ সরকারি কার্যালয় নির্মাণ করতে পারেননি। উঁচু-নিচু ঘন শ্যামল পাহাড়ের ধাঁর ঘেঁষে এমনভাবে ঢালু রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে, যেন বৃষ্টির পানি জমে না থাকে। এখনকার বড় বড় অট্টালিকা নির্মাতাদের নির্মিত এলাকা আগ্রাবাদ, হালিশহর, মুরাদপুর, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় বৃষ্টি পড়তে না পড়তেই পানিতে প্লাবিত হয়ে যায়। শুধু মেধাবী হলে হয় না, মেধাকে কাজে লাগানোর বুদ্ধিও থাকতে হয়। ইংরেজরা বৃটিশ আমলে চট্টগ্রামকে সুন্দর করে গড়ে তুলেছিল। কোর্ট বিল্ডিং, চট্টগ্রাম ক্লাব, সিআরবি প্রভৃতি সব এলাকায় গাছপালায় ঘিরে প্রাকৃতিক শোভার নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এখনকার নব্য শিক্ষিত ব্যক্তিদের লোভ এবং লালসা চট্টগ্রাম শহরকে কুশ্রী শহরে পরিণত করছে। যেটুকু সৌন্দর্য বাকী আছে তা এখন ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সব মার্কেট, কারখানা, হাসপাতাল কি শহরের সংকীর্ণ স্থানে হতে হবে? কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ভেলোরের হাসপাতাল শহর থেকে দূরে গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে সে সব গ্রামে শহরের মত বাড়িঘর, দোকানপাট নির্মিত হয়েছে। গ্রামের মানুষের জীবিকা অর্জনের পথ সুগম হয়েছে। চট্টগ্রামে সব কিছু চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে নির্মাণ করে শহরকে সংকীর্ণ, আবর্জনাময়, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত করেছে। এসব মানুষ চট্টগ্রামকে ভালবাসে না, চট্টগ্রাম শহরের প্রতি এদের কোন মমতা নেই।
আমাদের নবীজি (সাঃ) যখন মেরাজ শরীফের সময় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তখন হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। হযরত ইব্রাহিম (আ:) বলেছিলেন, “হে নবী, আমার উম্মতদের তুমি দু’টি জিনিসের কথা বলবে। ১. আমার উম্মতরা সবসময় আল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ্ এবং আলহামদুলিল্লাহ্ পড়বে এবং ২. পৃথিবীতে আমার উম্মতরা গাছ লাগাবে। পৃথিবীতে তারা যে গাছ লাগাবে, সে গাছ তারা বেহেশতে দেখতে পাবে”। তাছাড়া গাছ লাগানো সাদকায়ে জারিয়াহ্ এর অন্তর্ভুক্ত। তাহলে গাছ কাটতে কি বিবেক দংশন করবে না। যে প্রাকৃতিক পরিবেশে শত শত মানুষ আনন্দ লাভ করে, প্রকৃতির শোভা দর্শন করে মানসিক শান্তি লাভ করে, পাখিদের কাকলি অন্তরে অনাবিল আনন্দ সৃষ্টি করে, সেখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা কি সঠিক হচ্ছে? একটা ভালো কাজের জন্য আরেকটি উত্তম স্থানকে ধ্বংস করে কি সফলতা অর্জন করা সম্ভব?
আমার সামান্য প্রতিবাদ হয়তো কোন কাজে আসবে না। কিন্তু প্রকৃতি ধ্বংসকারীদের ধিক্কার জানিয়ে আমি মানসিকভাবে কিছুটা শান্তি লাভ করবো সে উদ্দেশ্যে আমার প্রতিবাদ। প্রকৃতি ও গাছ ধ্বংসকারীদের লক্ষ্য করে তাই কিছু কথা বলতে আমি দ্বিধা করলাম না।
লেখক : কবি, সাহিত্যিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ-চট্টগ্রাম











