কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ বাড়াচ্ছে আইসিডি

কার্যকর ১ সেপ্টেম্বর থেকে, শিপিং ও রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন করে সংকটের শঙ্কা

হাসান আকবর | সোমবার , ২১ জুলাই, ২০২৫ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান সহায়ক খাত হিসেবে স্বীকৃত বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো (আইসিডি) কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধি করার ঘোষণা দিয়েছে। বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ নির্ধারণ এবং আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে। এতে দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য নতুন করে সংকট সৃষ্টি করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিকডার কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা শিপিং লাইন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের কেউ মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পরস্পর বিরোধী অবস্থানে পুরো রপ্তানি বাণিজ্য এবং শিপিং সেক্টরে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

বিকডা সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে আইসিডিগুলো আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে আসছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি, যন্ত্রপাতির ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধিসহ ক্রমবর্ধমান ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পূর্বের হারে কার্যক্রম পরিচালনা করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনারের ক্ষেত্রে স্টাফিংয়ে ৬০ শতাংশ এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে ৩০ শতাংশ দর বৃদ্ধি করে ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন হারে হ্যান্ডলিং চার্জ আদায় করা হবে।

নতুন হারে ২০ ফুটি কন্টেনারের ক্ষেত্রে প্যাকেজ চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৯০০ টাকা, ৪০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১৩ হাজার ২০০ টাকা এবং ৪০/৪৫ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১৪ হাজার ৯০০ টাকা চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে। খালি কন্টেনারের হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রেও চার্জ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে গ্রাউন্ড রেন্ট ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১৫০ টাকা, ৪০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিবহন চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য আড়াই হাজার টাকা, ৪০ ফুট ও ৪৫ ফুটে ৫ হাজার টাকা, সর্বপ্রকার কন্টেনারের ডকুমেন্টেশন ফি সাড়ে চারশ টাকা। লিফটঅন/লিফটঅফ সাড়ে ৭শ টাকা। এছাড়া ভিজিএম চার্জ, শ্রমিক খরচ, প্লাগইন ফি, জিওএইচ চার্জ, কার্গো ও অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রেও চার্জ বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

বর্তমানে প্যাকেজ চার্জ (স্টাফিং থেকে বন্দরে প্রেরণ পর্যন্ত) ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ৬১৮৭ টাকা, ৪০ ফুট এবং ৪৫ ফুটি কন্টেনারের জন্য ৮২৫০ টাকা, গ্রাউন্ড ভাড়া (প্রতিদিন) ২০ ফুটি কন্টেনারের জন্য ১১৫ টাকা ৪০ ও ৪৫ ফুটি কন্টেনারের ক্ষেত্রে ২৩০ টাকা আদায় করা হয়।

নতুন চার্জ কাঠামো ঘোষণার পর থেকে দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত তৈরি পোশাক শিল্প যারা ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ধাক্কা সামলে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য রপ্তানি করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য এটি বড় সংকট সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখার যে নিরন্তর চেষ্টা, বিকডার এই মূল্য বৃদ্ধি তাতে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে বলে একাধিক গার্মেন্টস মালিক মন্তব্য করেছেন।

একাধিক রপ্তানিকারক জানিয়েছেন, এই খরচ সরাসরি পণ্যের কস্টিংয়ে প্রভাব ফেলবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে যেখানে ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো দেশ কম খরচে রপ্তানি সুবিধা দিচ্ছে, সেখানে অতিরিক্ত চার্জ বাংলাদেশের রপ্তানিকে ঝুঁকিতে ফেলবে।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯৩ শতাংশ এবং আমদানিকৃত কন্টেনারের ২০ শতাংশ হ্যান্ডলিং করে দেশের ১৯টি বেসরকারি আইসিডি। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতার তুলনায় ১২ গুণ বেশি খালি কন্টেনার আইসিডিগুলোতে সংরক্ষিত থাকে। ফলে একদিকে যেমন ডিপোগুলোর ওপর কন্টেনারের চাপ বাড়ছে তেমনি আইসিডির চার্জ বৃদ্ধি আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।

বিকডা বলেছে, ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য বর্তমানে অনেক আইসিডি মালিককে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিদ্যমান অবকাঠামো সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) কমে গেছে। নতুন আইসিডিগুলোও প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে চার্জ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।

দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য এবং শিপিং খাতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, সময়টা খারাপ। দেশের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্য সংবেদনশীল কঠিন সময় পার করছে। রপ্তানি আদেশ স্থগিত, বাতিল এবং হ্রাসের ঘটনা ঘটছে হরদম। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে কন্টেনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধি ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কিনা তা বিবেচনায় রাখা উচিত। তারা বলেন, সবাই মিলে সবার পাশে দাঁড়িয়ে খারাপ সময় পার করতে হবে। বিকডার বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে হবে; যাতে আইসিডিগুলো টিকে থাকতে পারে, বাণিজ্যিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২৫ বছরের বরাদ্দ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত বাফুফের
পরবর্তী নিবন্ধএনসিপির পদযাত্রায় স্লোগানে স্লোগানে মুখর নগরী