(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রথমবার তাজমহল দেখেছিলাম ট্রেন থেকে। ট্রেনের কামরা থেকে জানালা দিয়ে দূর থেকে দেখা তাজ আমার ভিতরে একটি আলোড়ন তুলেছিল। বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। এরপর আমি প্রিয়তমা স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে তাজমহল দেখেছি। এবার আমার তৃতীয় দফার তাজ দর্শন। এতে করে প্রথম দেখার চমকে উঠা না থাকলেও ভিতরটি নড়ে চড়ে উঠতে যেন ভুললো না। তাজ এমন এক সৃষ্টি যেটিকে দেখে চমকে না উঠার কোন সুযোগই নেই। হাজার বার দেখলেও মনে হয় এই দেখার শেষ হবে না। কিন্তু এই তাজমহল দেখে একটি কথা আমার বরাবরই মনে হয়, যাকে ভালোবাসি তাকে জীবদ্দশায় তা বলে ফেলাই ভালো। বেচারি মারা যাওয়ার পর তাজমহল বানানো হলেও তা কিন্তু মমতাজ দেখেননি।
চড়া দামে টিকেট কেটে ভিড়-ভাট্টায় না গিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। সবুজ চত্বরে দাঁড়িয়ে তাজের দিকে তাকিয়ে আমি আলতো করে স্ত্রীর হাত ধরলাম। গাইড বললেন, দিন, মোবাইল দিন, একটি ছবি তুলে দিই। আমি মোবাইল ফোনটি গাইডের হাতে দিয়ে স্ত্রীর হাতটি আরো শক্ত করে ধরলাম। গাইড আমাদেরকে তাজমহলের কোন কোন পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে সুন্দর হয় তার একটি বর্ণনা দিলেন।
তাজমহল আসলে একটি সমাধি। রাজকীয় সমাধি। এখানে সম্রাট শাহজাহানের কবর রয়েছে। রয়েছে সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগম যিনি মমতাজ মহল নামে পরিচিত তার সমাধি। সম্রাট শাহজাহানের অতি ভালোবাসার ধন এই স্ত্রী চৌদ্দতম সন্তান গৌহর বেগমের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যুতে প্রচণ্ড শোকাহত সম্রাট ভালোবাসার এক অমর নিদর্শন তৈরি করতে তাজমহল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। জীবনের মতো মরণের পরেও স্ত্রীর পাশাপাশি থাকার জন্য তিনি তাজমহল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তিনি এই তাজমহলেই স্ত্রীর কবরের পাশে নিজেও সমাহিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। যা তাঁর মৃত্যুর পর রক্ষা করা হয়েছে। তাজমহলের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে নানাভাবে উপকরণ সংগ্রহ করে শুরু করা হয় তাজের নির্মাণ যজ্ঞ। নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিকের ২১ বছর লেগেছিল প্রেমের এই অমর স্মৃতি তৈরি করতে। মানুষের পাশাপাশি শত শত হাঁড়ি ঘোড়াও লাগানো হয় অনন্য সুন্দর এই স্থাপনার নির্মাণ কাজে। যা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি হিসেবে খ্যাতি লাভ করে।
তাজমহল বা তাজ মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি আকর্ষণীয় স্থাপনা। এই স্থাপনা গড়ে তুলতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের এক মহাসম্মিলন ঘটানো হয়। তাজমহল নির্মাণ করতে গিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের রাজকোষে টান পড়েছিল বলেও উল্লেখ রয়েছে। একজন মুসলিম সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীর কবরকে ঘিরে গড়ে তোলা এই স্থাপনাকে ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এটিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের সার্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠকর্ম’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
আমরা হাঁটছিলাম। গাইড আমাদের বাগানের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। চমৎকার এক পরিখার পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটার রাস্তা। পানির চৌবাচ্চার ভিতরে তাজমহল প্রতিপলিত হচ্ছে। অনন্য লাগছিল সবকিছু। মন মেজাজ সবই ফুরফুর করছিল। গাইড জানালেন, বাগানটি চারবাগ বাগান নামে পরিচিত। মুঘল স্থাপনাগুলোতে এই ধরনের চারবাগ বা চার অংশে বিভক্ত বাগান থাকত। ইংরেজেরা এই বাগানের জৌলুস এবং আদিরূপ নষ্ট করে নিজেদের মতো করে বাগান করেছে।
বাগান পার হয়ে আমরা তাজমহলের চত্বরে পৌঁছলাম। চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মতো দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। যমুনা পাড়ের এই স্থাপনায় নদীর দিকে কোনো দেয়াল নেই। তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা। তবে আদি যমুনা এখন আর নেই। নদীর বহু অংশ দখল হয়ে গেছে। ভরে গেছে নদী। মরা এক নদী জুড়ে ময়লা আবর্জনার ছড়াছড়ি। আমরা তাজমহলের ভিতরে ঢুকলাম। সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীর কবর জেয়ারত করলাম। একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে আসলাম। প্রচুর ভিড়। আমাদের গাইড আমাদেরকে পথ চলতেও বেশ সাহায্য করছিলেন।
তাজের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অপার বিস্ময়। কি করে এমন একটি স্থাপনা ওই সময় নির্মাণ করা সম্ভব ছিল তা আমার মাথায় ঢুকেনা। সপ্তম আশ্চর্যের স্থাপনাগুলো প্রায় সবকটিই দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। সবগুলোই বড় বড় বিস্ময়। কিন্তু তাজের ব্যাপারটিতে বিস্ময়ের পাশাপাশি মুগ্ধতাও রয়েছে। পাথরগুলো কি করে এমন মসৃণ করা হলো, কি করে করা হয়েছিল এত কারুকাজ। এত রঙ বেরঙের পাথরও বা কোত্থেকে যোগাড় করা হলো। কি অসাধারণ সৃষ্টি, কী অপূর্ব সমন্বয়!
শুধু তাজই নয়, তাজকে ঘিরে আশেপাশে আরো বেশ কয়েকটি স্থাপনা হয়েছে। যেগুলোও কম জৌলুস ছড়াচ্ছে না। তাজমহলের দরোজা, প্রধান গেট সবই এক একটি অনন্য সৃষ্টি, মুগ্ধ করে রাখার মতো স্থাপনা।
আমাদের কোন তাড়া নেই, নেই ব্যস্ততা। নিজেদের মতো করে ঘুরছিলাম আমরা। গাইড আমাদের পথ দেখিয়ে নানা কিছু দেখাচ্ছিলেন। তাজের চারদিকে ঘুরছিলাম আমরা। পাথর থেকে পাথরে বিস্ময়ের হদিস করছিলাম। পেছনে যমুনার পাড়ে গিয়েও অনেকক্ষণ দাঁড়ালাম। চত্বরে হাঁটলাম। তাজমহল চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে বেশ ক্লান্ত হয়ে উঠলো আমার স্ত্রী। কোথাও একটু বসার আগ্রহ প্রকাশ করলো সেই। সম্রাট শাহজাহান ভালোবাসার মানুষের জন্য তাজমহল বানিয়েছেন, আমি স্ত্রীকে একটু বসাতেও পারবো না। গাইডকে কথাটি বলতেই তিনি বললেন, ‘কোন সমস্যা নেই। চলুন ওপাশে গিয়ে বসি।’ আমরা হেঁটে তাজের উত্তর পাশে গেলাম। কিছুটা ছায়া খুঁজে নিয়ে তাজমহলের দেয়ালে হেলান দিয়ে বেশ আয়েশ করে বসলাম। একদিন এই তাজের ধারে কাছেও আমার মতো সাধারণ মানুষের ভিড়ার সুযোগ হয়তো ছিল না, আজ আমরা তাজের দেয়ালে হেলান দিয়ে আয়েশ খুঁজছি। কি মসৃণ দেয়াল, কী মোলায়েম মার্বেল পাথর! আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল দিনটি কী অপূর্ব সুন্দর! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।