স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষা উপকরণের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা জরুরি

আয়েশা পারভীন চৌধুরী | শনিবার , ৩ জুন, ২০২৩ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর এই শিক্ষাকে সহজলভ্য করার দায়িত্ব আমার আপনার সবার। বর্তমান বিশ্বে বাজার দরের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বাংলাদেশেও প্রতিটি জিনিসের দাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জন্য এক্কেবারে নিম্ন মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিটি সদস্য এখন এক ধরনের জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ মারণাস্ত্র সরঞ্জাম নিয়ে নয়। এই জীবন যুদ্ধ হচ্ছে আর্থিক সংগতির সাথে সমন্বয় রেখে জীবিকা নির্বাহের জন্য।

এই অতি অভাবী মানুষগুলো যখন তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করার মতো সিদ্ধান্ত নেন তখনই নানা বাধাবিপদের সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের প্রথম তারিখে বই উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে বই বিতরণ করা হয়। বিনা বেতনে অধ্যয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর চাপের বোঝা কমানোর চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল গম দিয়ে স্কুলে শিক্ষার্থীদের ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। তাছাড়া নানানভাবে বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উৎসাহ প্রদান করা হয়। তবুও প্রতি বছর পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পরে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। বর্তমান বাজারদরে একজন মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মিটানো অনেক কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় শিক্ষা চালানোর জন্য শিক্ষা উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি যেন আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে। লেখাপড়া চালানোর জন্য চক, ডাস্টার, কাগজ, কলম, পেন্সিল, রাবার ইত্যাদি জিনিসগুলো খুব বেশি প্রয়োজনীয়। অথচ ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে এই জিনিসগুলোর দাম দিন দিন অতিরিক্ত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া প্রতিটি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সমন্বয় রেখে খাতা কাগজ কলম পেন্সিল বই পত্র ইত্যাদি জিনিস অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে। শিক্ষা উপকরণের অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির ফলে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সাহায্যকারী বইগুলো অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ক্রয় ক্ষমতার বাহিরে চলে গেছে। এক একটি বইয়ের ওপর অধিক হারে মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাতে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন নতুন বই কেনাকাটার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন হয়। তাছাড়া প্রতি বছর উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণির জন্য নতুন নতুন পাঠ্যবই ও অন্যান্য সহকারী বই খাতা কিনতে হয়। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে ড্রইং ও প্রেকটিকেলের জন্য চড়া দামে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়ে যায়। এক সময় পুরনো বই খাতার দোকানে কম মূল্য দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র বই কেনা যেত। কিন্তু বর্তমান দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে সেই পুরোনো জিনিস পত্রগুলো অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন শ্রেণির জন্য সেশন ফি’র মত অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করতে হয়। যারা নতুন ভর্তি হয় তাদেরকে নতুন করে সেই প্রতিষ্ঠানের নিয়ম নীতি অনুযায়ী স্কুল ড্রেস সেলাই করতে হয়। পায়ের জুতা থেকে মাথার ফিতা পর্যন্ত নতুন করে কিনতে হয়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয়ে নতুন বই কিনতে হয়। গবেষণা সংক্রান্ত প্রতিটি বিষয় সময় ও চাহিদা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে যারা গবেষণার সাথে জড়িত তাদের শিক্ষা ও গবেষণার সংক্রান্ত শিক্ষা উপকরণগুলো ক্রয় করার জন্য প্রচুর পরিমাণ আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ক্ষেত্রে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিটি জিনিসের ওপর চরম প্রভাব ফেলেছে। সাথে সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয়ভার দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সেই অতিরিক্ত ব্যয়ের অনেকটা চাপ শিক্ষার্থীদের ওপর এসে পড়ে। মাসিক বেতনের সাথে সাথে প্রতিটি পরীক্ষার ফিস ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতির সাথে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েছে। বর্তমানে শিক্ষা অর্জনের প্রচেষ্টা নিম্নআয়ের ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য বিলাসিতায় পরিণত হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগ পেরিয়ে এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আর এ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষাকে সর্বস্তরে এবং সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়া। আর শিক্ষাকে যদি সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য হয় তাহলে তার প্রধান লক্ষ্য হবে শিক্ষা উপকরণগুলো সহজলভ্য করে তোলা। বিশেষ করে খুব সাধারণ শিক্ষা উপকরণগুলো যেমন পেন্সিল কলম কাগজ স্কেল রাবার ইত্যাদি জিনিসগুলোর দাম বেড়েছে অনেক। অথচ হাতে খড়ি অর্থাৎ হাঁটি হাঁটি পায়ে শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের সময় এই শিক্ষা উপকরণগুলো খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা জানি; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ধাপে ধাপে শিক্ষা ব্যবস্থা বিনা বেতনে করার চেষ্টা করছেন। এদেশের কোনও মানুষ যাতে অশিক্ষিত না থাকে ও কোনও শিশু যেন শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য বিনা বেতনে অধ্যয়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছেন। সাথে সাথেই স্কুল টিফিনেরও ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে স্কুলের প্রতি আগ্রহী করে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আমাদের দেশের একেবারে নিম্ন আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীরা একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। জীবন ও জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন জায়গায় কাজে যোগ দেয়। নিজেকে চালিয়ে যাবার সংগ্রামী মনোভাব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ন্যূনতম মৌলিক চাহিদাগুলো যেখানে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে সেখানে শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া তার কাছে বিলাসিতার পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়।

দ্রব্যমূল্যের এমন অবস্থায় পাঠ্যসূচির পাশাপাশি অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ কিনতে গিয়ে নিম্ন আয়ের পরিবারের অভিভাবকদের অনেক বেশি কষ্ট হয়। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ব্যাপকভাবে পার্থক্য থাকাতে সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়টি বিলাসিতার পর্যায়ে বিবেচিত হয়। এমনকি দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে পাঠ্যবই ছাপার ক্ষেত্রে। নিম্নমানের কাগজ হওয়ায় ক্ষুদে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের পড়ার ক্ষেত্রে চোখের সমস্যা হচ্ছে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের অভিযোগের ভিত্তিতে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর বিষয়টি বার বার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।

সম্প্রতি আমাদের পাঠ্য বইগুলো হতে বিভিন্ন ধরনের ভুল ভ্রান্তির অভিযোগ আছে। বছরের শুরুতে বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বই বিতরণ করা হয়। পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার আনন্দ বিলিয়ে দেয়। আরো উদ্দেশ্য হচ্ছে; শিক্ষার্থীদেরকে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং তাদের মাঝে শিক্ষার বীজ বপন করা। শিক্ষাকে সহজলভ্য করার জন্য একটি সহজ ও সহনীয় মনমানসিকতা এখন সময়ের দাবি। ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থাকে উদার ও মানবিক দৃষ্টিতে সাজিয়ে সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে শিক্ষা উপকরণের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিকল্প নেই।

লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ

ডা. ফজলুলহাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব মানুষের প্রিয় হয় না কোনো মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে