চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম ও ট্রাফিক বিষয়ে বহুবিধ সমস্যা নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, অন্যকোন বিষয় নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে কিনা সঠিক বলা যাচ্ছেনা (আমি নিজেও অনেকবার লিখেছি)। শহরের রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য যত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং চলমান আছে-সবই ট্রাফিক সমস্যা নিরসনের জন্য। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, ‘ট্রাফিক সমস্যা’ যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই আছে। পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি বা হলেও তা এতো কম যে-দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম শহরের কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরা যাক। ‘জিইসি মোড়’ ও ‘মুরাদপুর মোড়’কে স্থায়ীভাবে যানজট মুক্ত রাখার জন্য উক্ত দু’স্থানে সরাসরি রাস্তা পারাপার (ক্রসিং) বন্ধ করে ‘ইউটার্ন’ করা হলো। কিন্তু না,যে লাউ সেই কদু। মুরাদপুরের দুদিকের রাস্তায় বাস,টেঙি, টেম্পো, রিঙা-রাস্তার অধিকাংশ অংশ দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে যাত্রীর জন্য। জিইসির অবস্থাও একই। এর উপর স্থায়ী ভাবে যুক্ত হয়েছে প্রতিটি মোড়ে ‘স্ট্রিট ফুডের’ হকার। তারা এমন ভাবে ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে থাকে, ফলে হাঁটা বা ওভার ব্রীজে উঠার পথও খুঁজে পান না। এমন সব বহুবিধ ঝঞ্জাটের ফলে ‘সিগন্যাল’ পাওয়ার পরও মূল সড়কের গাড়ি গুলো দ্রুত বা স্বাভাবিক গতিতে মোড় পার হতে পারে না। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়। এদিকে ষোলশহর দুই নম্বর গেইট, ওয়াসা, নিউমার্কেট মোড়, কোতোয়ালি, আন্দরকিল্লা, টেরিবাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজার, জুবলিরোড প্রভৃতি এলাকার যানজট পরিস্থিতি তো প্রতিদিনই সবাই দেখছি। সিরাজদ্দৌলা রোড ও চকবাজার এলাকায় কাঁচা তরকারির ভ্যানগাড়ির জন্য গাড়ি চলতে পারে না। বহদ্দারহাট, একে খান মোড়, দেওয়ান হাট ও অঙিজেন মোড়ের যানজট ইতিহাসে স্থান পেতে বসেছে। ঢাকা হতে চার ঘন্টায় ভাটিয়ারি আসা গেলেও ‘একে খান মোড়ের’ জ্যামের কারনে দামপাড়া পৌঁছানোর জন্য আরও দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। বহদ্দারহাট মোড়ের ৭০% এলাকা হকার ও এলোপাতাড়ি যানবাহনের দখলে থাকে। বর্তমান মেয়র মহোদয়ের বাড়ির সামনের রাস্তার অধিকাংশ অংশ হকারদের দখলে থাকে। নতুন চান্দগাঁও থানার সামনেই গড়ে উঠেছে কঙবাজারগামী অবৈধ বাস স্ট্যান্ড। এই স্থানে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির বাস সার্বক্ষণিক এলোপাতাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে, ফলে যানজট দীর্ঘ হয়। কোন উন্নত দেশে রাস্তার উপর এমন অবৈধ বাস স্ট্যান্ড অকল্পনীয়। এই অবৈধ স্ট্যান্ডের কারনে ‘খাজারোড’সহ পুরো এলাকায় সারাক্ষণ যানজট লেগে থাকে। ‘অঙিজেন’ এলাকার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। জ্যাম লাগলে আর ছুটে না। (সামান্য উন্নতি হয়েছে কর্নফুলি ব্রীজ এলাকায়)। ফিরিস্তি দিয়ে যানজট পরিস্থিতি লিখে শেষ করা যাবে না।
প্রশ্ন হলো, কেন এই যানজট এবং কেনই বা এর অবসান হচ্ছে না! এর উত্তর আমরা সবাই জানি, তবুও একটু উল্লেখ করা যেতে পারে। কারন গুলোর অন্যতম হলো-ট্রাফিক আইন/নিয়ম না জানা, ইচ্ছেকৃত ভাবে ট্রাফিক নিয়ম অমান্য করা, ট্রাফিক পুলিশের স্বল্পতা, ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা (বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়া এবং ট্রাফিক আইন প্রয়োগে শিথিলতা), রাজনৈতিক প্রশ্রয়/চাঁদাবাজি, মোড়ের মধ্যে বাস-টেঙি- টেম্পো-রিঙার জটলা ও হকারদের দাপট, পথচারিদের এলোমেলো রাস্তা পার হওয়া, যাত্রীদের রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা, রাস্তার মোড়েই গাড়ির কাগজপত্র চেক করা, ফুটপাত/রাস্তা দখল, ধীর ও দ্রুত গতির গাড়ি এক লেনে চলাচল করা, যত্রতত্র অবৈধ পার্কিং, অভিজ্ঞ ড্রাইভারের স্বল্পতা, জায়গা না থাকা সত্ত্বেও ওভারটেকিং, হাসপাতাল -শিক্ষা প্রতিষ্ঠান -রেস্টুরেন্ট-মার্কেটের নিজস্ব পার্কিং না থাকা ইত্যাদি যানজটের অন্যতম কারন। তাছাড়া ফ্লাইওভার তৈরি, ওয়াসার খোরাখুরি এবং জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ ইত্যাদির জন্যও সাময়িক যানজট সৃষ্টি হয়।
এই যানজটের ফলে শুধুমাত্র যে চলাচলে সমস্যা হচ্ছে তা নয়। এরফলে ‘শ্রমঘন্টা নষ্ট’ হচ্ছে, সৃষ্ট ধুলোবালির কারনে মানুষের ‘রোগব্যাধি সৃষ্টি’ হচ্ছে এবং বিশাল ‘অর্থনৈতিক ক্ষতি’ হচ্ছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোডের্র (বিওআই) পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার, যা মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান৷ অথচ আমাদের দেশের গাড়িও উন্নত দেশের চেয়ে অনেক কম। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকায় যেখানে প্রতি এক হাজার বাসিন্দার জন্য গড়ে তিনটি গাড়ি চলে, সেখানে শিল্পোন্নত দেশের মেগাসিটিগুলোতে প্রতি হাজার বাসিন্দার জন্য গাড়ির সংখ্যা হলো ৭০০! সুতরাং বুঝা যাচ্ছে ‘গাড়ি সংখ্যা’-যানজট সৃষ্টির ‘মূল কারণ নয়’। মূল কারণ হলো, ‘সঠিক ট্রাফিক নিয়ম’ সম্পর্কে আমাদের কারোরই (ট্রাফিক বিভাগ ও জনগণ) ভাল ধারণা না থাকা এবং ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। তাছাড়া আইন প্রয়োগের ব্যাপারে শিথিলতাও ট্রাফিক বিশৃঙ্খলার অন্যতম কারন। মানুষ সভ্য প্রাণী হলেও অধিকাংশ মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য হলো- ইচ্ছেমত চলার প্রবণতা বা আইন অমান্য করা। লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, মানুষ আপনাপনি নিয়ম/আইন মান্য করে না। ‘আইনকে মানাতে হয়’। আইনের কঠোর প্রয়োগ করেই মানুষকে ঠিক পথে রাখতে হয়। তাই পৃথিবীর সব দেশেই ‘আইনের যথাযথ প্রয়োগ’ করেই ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা’ বজায় রাখা হয়। যা আমরা এখনও রপ্ত করতে পারিনি।
যানজট পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত অবনতি হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে উড়ালপথ বা মেট্রোরেল যা-ই হোক, ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা হতে আমরা রক্ষা পাবো না, যদি ‘ট্রাফিক নিয়ম’ শতভাগ বাস্তবায়ন করা না যায়। ট্রাফিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমাদের বিশাল জনসংখ্যা, রাস্তার স্বল্পতা ও লোকবলের কারনে হয়তো শতভাগ শৃংখলা আনা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলে ‘আশি ভাগ যানজট নিরসন’ হবে। পদক্ষেপ গুলো হলো (১)শহরের রাস্তার মোড়গুলোকে হকার ও জটলা মুক্ত করে গাড়ি গুলোকে দ্রুত চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করা। (২)বামে যাওয়ার লেন খালি রেখে বামের গাড়ি গুলোকে চলে যাতে দেয়া।(৩) মোড় হতে ২০০ গজ দূরে ‘বাস বে’ সৃষ্টি করা(যতটুকু সম্ভব)। পৃথিবীর সব দেশে যাত্রী উঠানামার জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়/স্টপেজ আছে। আমাদের এখানেও ২৫/৩০ বছর আগে এ ধরনের স্টপেজ ছিল। কিন্তু এখন সব উঠে গেছে।(৪) মূল সড়কের ডানের একটা লেন- দ্রুত গতির গাড়ির জন্য খালি রাখা। এই লেনে কোন বাস দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে অবশ্যই জরিমানা করতে হবে।
(৫) জেব্রা ক্রসিং দেয়া। (৬) মোড়ের মধ্যে দায়িত্বরত সার্জেন্ট/কনস্টেবল কর্তৃক হুট করে গাড়ির কাগজপত্র চেক না করা। কাগজপত্র চেক করবে প্রশস্ত ও ফাঁকা রাস্তায়। (কাগজপত্র চেক করার জন্য পৃথক ইউনিট সৃষ্টি করা যায়। যে ইউনিটে পালা করে সবাই দায়িত্ব পালন করবে)। (৭) রাস্তার পাশের বহুতল ভবনে(আবাসিক ও বাণিজ্যিক) শতভাগ পার্কিং নিশ্চিত করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বিপণিকেন্দ্রের পার্কিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। (চমেক হাসপাতালের সামনে ইপিক হেলথকেয়ার ভবনের গাড়ির কারনে এই এলাকায় স্থায়ী যানজট হচ্ছে)। (৮) ধীর ও দ্রুতগতির গাড়ির জন্য আলাদা লেন চালু করা। (৯) ট্রাফিক আইনের ব্যাপারে জনগণ ও চালকদের সচেতনতার জন্য প্রচারণা চালানো। চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। (১০)ছোট ছোট টেম্পো আমদানি বন্ধ করে ৫২ সীটের বাস বৃদ্ধি করা। মোটর সাইকেলকে নিয়ন্ত্রণে আনা। (১১) দিনের বেলা ট্রাক চলাচলের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। (১২) একেকটি মোড়কে টার্গেট করে ‘ট্রাফিক সপ্তাহ পালন’ করা।(১৩) সিটি কর্পোরেশন,ট্রাফিক বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সম্মিলিত ভাবে প্রতি মাসে ট্রাফিক জ্যাম মনিটরিং করবে এবং যে স্থানে জ্যাম বেশি হবে সেটা নিরসনের ব্যবস্থা নেবে। (১৩) বিআরটিএ কে দূর্নীতি মুক্ত করা। (১৪) শহরের প্রবেশ মুখ গুলোকে স্পেশাল কেয়ার নিয়ে যানজট মুক্ত রাখা। (১৫) রাস্তা-ফুটপাত অবৈধ দখল মুক্ত করার জন্য এক/দুই মাস সময় দিয়ে নোটিশ দিতে হবে এবং সময়ের পর উচ্ছেদ করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত ভাবেই এই কাজ করতে হবে। তাছাড়া দীর্ঘ মেয়াদি কিছু পদক্ষেপ যেমন- গুরুত্বপূর্ণ মোড়/রাস্তা প্রশস্ত করা, ট্রাফিক বিভাগে জনবল বৃদ্ধি করা, টার্মিনাল গুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, স্কুল ও অফিসের সময়সূচির পরিবর্তন করা, প্রয়োজনীয় স্থানে ইউলুপ কিংবা ওভারপাস নির্মান করা। বহদ্দারহাট টার্মিনালকে কর্ণফুলী ব্রীজের কাছে স্থানান্তর করা,বন্দরে পণ্য পরিবহনের জন্য আসা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানের জন্য নির্দিষ্ট টার্মিনাল নির্মাণ করা ইত্যাদি। আমাদেরকে ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা নিরসনের জন্য সিরিয়াসলি উদ্যোগ নিতে হবে। আশাকরি, সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ট্রাফিক শৃংখলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।