(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হংকংয়ের রাস্তা ধরে আমরা হাঁটছিলাম। আমরা মানে আমি এবং আমার হংকং প্রবাসী বন্ধু স্বপন। ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম আমরা। স্বপনের বাসা পেছনে ফেলে ক্রমে সামনের দিকে হাঁটছিলাম। মূলতঃ সারাদিনই অনেকটা হাঁটার উপর রয়েছি। এতো হাঁটাহাঁটি দেশে করলে শরীরটা কবে যে একশ’ভাগ ফিট হয়ে উঠতো!
আলোয় আলোয় ভরে আছে চারদিক। পৃথিবীর সেরা শহরগুলোর একটিতে হাঁটতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল সুখের ফোয়ারা বুঝি এখানেই নিরন্তর ছুটছে। ৩ শ’ বর্গফুটের বাসায় বসবাস করেও এখানে যেনো সুখের কমতি নেই। সামাজিক নিরাপত্তা, নির্ভেজাল খাদ্য, নির্মল পরিবেশ, ছন্দময় গতি, আর্থিক সচ্ছলতাসহ একজীবনের জন্য যা কিছু দরকার তার সবই পাওয়া যায় এখানে। স্বপনকে কথাটি বলতে সে বললো, থেকে যাবি নাকি? ব্যবস্থা করবো? আমি মাথা নাড়লাম। আমার দেশের অনেক কিছু না থাকলেও যা আছে তার মায়া কোনদিনই ছাড়তে পারবো না ভাই। কথায় কথায় তাকে জানালাম যে, তোর মতো আমাকে আমেরিকায়ও থেকে যেতে বলেছিল, ইউরোপের একাধিক দেশেই চাইলে থেকে যেতে পারতাম। কিন্তু নিজের পোড়া দেশটি ছাড়া অন্য কোন দেশে থাকার কথা ভুলেও ভাবতে পারি না, ভাবি না। স্বপন বললো, দেশকে অনেক ভালোবাসি। তবুও নানা কারনে আমাদের থাকা হলো না। এখানে এসেছিলাম দুচার বছরের জন্য, কিন্তু কেমোন করে যেন আটকে গেলাম।
সামনে হাঁটছিলাম আমরা। ফুটপাতের পাশে সব দোকানপাট, সবগুলো ভবনই সুউচ্চ। এসব ভবনের উপরের দিকে আবাসিক এ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। কোন কোন ভবনে রয়েছে অফিস। বিশ্ববাণিজ্যের বহু কিছু এই হংকং থেকে পরিচালিত হয়, হয় নিয়ন্ত্রিত। এখানকার ছোট্ট ছোট্ট অফিসগুলো থেকেই কোটি কোটি ডলারের বেসাতি চলে।
আবারো একটি শপিংমলের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। স্বপন আমার হাত ধরে বললো, আয়, দারুণ একটি জিনিস দেখাবো। আমাদের দেশে এরূপ একটিও শপিংমল নেই, অথচ এখানে শুধু এই একটিই নয়, আরো অনেকগুলো আছে।
কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙ্গে আমাদেরকে শপিংমলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছাতে হলো। নিচে বেশ কয়েক ফ্লোর নাকি পার্কিং। গাড়ি রাখার জায়গার বড় আকাল হংকংয়ে। তাই সুউচ্চ ভবনগুলোর বেসমেন্টে কয়েক ফ্লোর মাটির নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এগুলোর অধিকাংশই পার্কিং। কোন কোন ভবনে বেসমেন্টে অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও রয়েছে।
মার্কেটের গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো এটি শুধু একটি শপিং মলই নয়, বিশাল এক বাজার। সামনে থেকে ছোট মনে হলেও পেছনের দিকে এক চোখের পথ। দোকানে দোকানে ঠাসা সব পণ্য। বিভিন্ন ব্র্যান্ডশপও দেখা গেলো। কেনাকাটার কোন ব্যাপার স্যাপার না থাকায় আমরা হেঁটে লিফটের কাছে গেলাম। স্বপনই আগে লিফটে প্রবেশ করলো। আরো অনেকেই লিফটে চড়েছেন। যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী বোতাম টিপছেন। আমাকে হাত ধরে নামিয়ে আনলো স্বপন। লিফট থেকে বেরিয়ে এক চক্কর ঘুরতেই আমার চোখের সামনে অবিশ্বাস্য রকমের একটি সৌন্দর্য ধরা পড়লো। বিশাল ফ্লোরের পুরোটাই কাচে ঘেরা। ভিতরে আইস জমিয়ে স্কি করা হচ্ছে। এমন একটি আয়োজন ইউরোপ কিংবা আমেরিকার কোথায় যেনো দেখেছিলাম। ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। ওখানেও শপিংমলের ভিতরে একটি স্কি স্টেডিয়ামের মতো করে গড়ে তোলা। বরফে বরফে সাদা হয়ে থাকা ফ্লোরের উপর স্কি করছিল নানা বয়সী শিশু কিশোর এবং যুবক যুবতীরা। ওটা বরফের দেশ ছিল, তাই পাকা ভবনের কয়েক ফ্লোর উপরেও বরফ রাজ্য বানিয়ে রেখেছিল। কিন্তু হংকংয়ে বরফ নেই, কখনো পড়েনা। এমন একটি দেশে একটি শপিংমলের এতো উপরে এমন করে বরফরাজ্য বানিয়ে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। আমি স্কি করবো কিনা জানতে চাইলো স্বপন। বললো, চল, ঢুকি। আমি হাড়গোড় ভাঙ্গতে চাইনা বলে একটু পেছনে সরলাম। রেলিং ধরে কিছুটা ঝুঁকে আমরা বরফ রাজ্যের খেলা দেখছিলাম। আমাদের মতো আরো অনেকেই বরফের উপর ছোটাছুটি দেখছিল।
বেশ কিছুক্ষণ বরফের উপর নানাজনের নানা কসরত দেখে সময় কাটালাম আমরা। স্বপন বললো, চল। তার সাথে আমিও পা চালালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এসে পৌঁছালাম একটি গেম জোনের সামনে। স্বপন টিকেট করলো। আমরা ভিতরে ঢুকলাম। স্বপন বেশ কয়েকটি গেম উপভোগ করার জন্য একসাথে টিকেট করেছে। আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে চোখে বড়সড় একটি কালো চশমা লাগিয়ে দিল। আমি বাইরের কিছু আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে অল্পক্ষণের মধ্যে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো যে, আমি একটি দ্রুতগামী যানের উপর বসে আছি। সেটি ছুটতে শুরু করেছে। আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে, আমার চেয়ার টেয়ার সবই ছুটছে। ভীষণ রোমাঞ্চকর। এমন খেলা আমাদের দেশেও রয়েছে। রয়েছে চট্টগ্রামেও। তবে প্রথম এমন একটি বিষয়ের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছিল আমেরিকার লসএঞ্জেলসের হলিউডে। কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা!
গোলাগুলির মাঝে পড়ে গেলে মানুষ যে কেমন বেদিশা হতে পারে সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম। আমার কানের পাশ দিয়ে মাথার উপর দিয়ে এক একটি গুলি ছুটে ছুটে যাচ্ছিল। আমি সত্যি সত্যি আগুনের হল্কার আঁচ পর্যন্ত পাচ্ছিলাম। তবে হংকংয়ের এই গেমজোনে যে চেয়ারটিতে আমাকে বসানো হয়েছে সেখানে গোলাগুলির কোন ঘটনা ঘটলো না।
বুড়োদের খেলাধুলা শেষ হলো। স্বপন আমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। বললো, এবার কী বাসায় ফিরে যাবি, নাকি কোন ক্লাব ট্লাবে যাবি? আমি বাসায় ফেরার কথা বললাম। ক্লাবে যাওয়ার অভ্যেস এবং ইচ্ছে আমার নেই বলেও স্বপনকে জানালাম। স্বপন হাসলো, বললো, বিদেশে এসেছিস, একটু ঘুরে টুরে গেলে সমস্যা কি? আমরা তো আর খারাপ কিছু করবো না। কিছুক্ষণ নাচ গান দেখে শুনে সময় কাটাতে পারতি। হংকংয়ের নাচ গানের আমি কি বুঝবো? স্বপন আর কথা বাড়ালো না। বললো, চল, বাইরে যাই।
শপিং মলের বাইরে এসে স্বপন আবারো সামনের দিকে হাঁটলো। হাঁটতে হাঁটতে সে মোবাইল টিপছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ি এসে থামলো। স্বপন ড্রাইভারের সাথে কি কি যেনো কথাবার্তা বললো। উবারের মতো আয়োজন। আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম।
গাড়ি ছুটছিল। হংকংয়ের রাস্তা ধরে গত কয়েকদিনে এভাবে বহু পথ পাড়ি দিয়েছি। আমার মনে হচ্ছে একই পথে কয়েকবারও চলেছি। রাত নেমে গেছে অনেকক্ষণ আগে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও অনেক। ঘরমুখো মানুষের চাপ রাস্তায়। তবে দুর্দান্ত এক শৃংখলায় সবকিছু খুবই অবলীলায় ম্যানেজ করা হচ্ছে।
আমরা বাসার সামনে এসে থামলাম। এটি আমার অপর বন্ধুর বাসা। যে বাসাটিতে গত কয়েকদিন ধরে আমি অনেকটা রাজার হালে বসবাস করছি। আমার এই বন্ধুটি অসুস্থ। তবুও আমার যাতে কোন সমস্যা না হয় সেদিকে ওনার সজাগ দৃষ্টি। বিশাল বাড়ি নিয়ে থাকেন আমার এই বন্ধু। আড়াই তলা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরের পুরোটাই ড্রয়িং রুম এবং ডাইনিং। পাশে ড্রাইভারের থাকার ঘর। বাড়িতে ঢুকতেই আমার বন্ধুর সাথে চোখাচোখি হলো। গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে তিনি টিভিতে বাংলা চ্যানেলে খবর দেখছিলেন। বললেন, ‘কেমন কাটালেন সারাদিন? নিশ্চয় স্বপন বহু জায়গা ঘুরিয়ে এনেছে। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন? ড্রাইভারতো সারাদিন এমনিতেই বসে থাকে। আমি তো কোথাও যাই না।’ দিনমান ছুটে বেড়ানো আমার বন্ধুটির অসহায়ত্ব কষ্ট দিচ্ছিল আমাকে। ওনাকে তা বুঝতে না দিয়ে আমি সারাদিনের গল্প সংক্ষেপে বললাম। বহু জায়গা ঘুরে বহু কিছু দেখেছি শুনে আমার বন্ধু খুশী হলেন। ওনার চোখ চিকচিক করে উঠলো।
আমার ফেরার খবর শুনে দোতলা থেকে নেমে আসলেন ভাবী। স্বপন ওনাদের পরিচিত। হংকংয়ের মতো ব্যস্ত অথচ ছোট্ট শহরে একই সাথে থাকার ফলে পরস্পরের সাথে তাদের সম্পর্কও দারুণ। ভাবী স্বপনের পরিবারের খোঁজ খবর নিলেন। স্বপন উঠতে চাইলে আমার বন্ধু এবং ভাবী দুজনই হৈ হৈ করে উঠলেন। ডিনার করে যেতে হবে। স্বপন ডিনার বাসায় গিয়ে করবে বলে বেরুতে চাইলেও জোরাজুরির কারণে তাকে আবারো বসতে হলো। ভাবী ডিনার সার্ভ করার জন্য দুর্বোধ্য ভাষায় কাজের মেয়েটিকে নির্দেশ দিলেন। ডিনারের আগে চা কফি কিছু খাবো কিনা জানতে চাইলেন আমার বন্ধু। বললেন, আপনি তো সারাদিন চা কফির উপরে থাকেন। ডিনার সার্ভ করতে করতে এক কাপ চালিয়ে দেবেন নাকি! ভাবী হেসে উঠলেন। বললেন, এমনভাবে বলছো যেনো ডিনারের আগে তুই ভাইকে বিয়ার সার্ভ করছো! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।