স্মৃতিপটে ফজলুল কাদের চৌধুরী

হাশিমুদ্দিন আহমদ | শুক্রবার , ১৮ জুলাই, ২০২৫ at ৬:৩০ পূর্বাহ্ণ

ইতিহাসের প্রয়োজনে আর ভবিষ্যৎ বংশধরের বৃহত্তর স্বার্থে বর্ণাঢ্য নেতৃবর্গের কর্মময় জীবনকে অবশ্যই দিকদর্শন হিসেবে স্মরণ করতে হয়। তেমনি স্মরণীয় একটি নাম ফজলুল কাদের চৌধুরী। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের সংগ্রামে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রথম ও একমাত্র মুসলিম লীগ নেতা হিসাবে কারারুদ্ধ সাজাপ্রাপ্ত চৌধুরীর ত্যাগ ও অবদানের কথা চিরঞ্জীব হয়ে আছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগদানের প্রশ্নে কায়েদআজমের সাথে মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ায় শেরে বাংলা ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মুসলিম লীগ ত্যাগ করে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু মহাসভার সাথে আঁতাত করে ঐ মাসেই পুনঃ মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার জন্য মওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ কে চেয়ারম্যান করে বাংলা মুসলিম লীগ একটি শক্তিশালী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ঐ সময়ে সর্বভারতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত মুসলিম ছাত্রনেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে কমিটির সেক্রেটারি করা হয়েছিল। তখন তিনি নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক।

সংগ্রাম পরিষদের সেক্রেটারি হিসাবে জনাব চৌধুরী যথার্থ সংগ্রামী নেতৃত্বের উজ্বল স্বাক্ষর রাখেন। কলকাতা মুহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রতিবাদ সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। সেদিন শুনেছিলাম চট্টগ্রামের সিংহের গর্জন। তেজোদ্দীপ্ত নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন ‘জেল হোক আর ফাঁসি হোক এই আন্দেলন সাফল্য মণ্ডিত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হব না।’

১৯৪২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার ডিআরআই কারারুদ্ধ করে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়। তাঁর গ্রেফতারের প্রতিবাদে দৈনিক আজাদ, মর্নিং নিউজ, আনন্দ বাজার পত্রিকায় ঝড় উঠেছিল। মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন এবং বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রদেশ ও জেলায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছিল। কায়েদে আজম, সোহরাওয়ার্দ্দী, শাহনেওয়াজ ভুট্টোর মত প্রবীণ নেতৃবর্গ তার বার্তা ও বিবৃতি দিয়ে তাকে ‘প্রথম মুসলিম মুজাহিদ’ আখ্যায়িত করেছিলেন।

১৯৪৬ সালে সিরাজগঞ্জে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলে ফজলুল কাদের চৌধুরী ‘আই ডিড নট ট্রাই’ দিয়ে পর পর একুশটি বাক্য উচ্চারণকালে সমস্ত কাউন্সিল করতালিতে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর নামে জিন্দাবাদ শ্লোগান দেয়াতে সভাপতির আসনে উপবিষ্ট কায়েদআজম অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে উচ্চারণ করেছিলেন ‘মাই বয় ইউ হ্যাভ প্রুভড ইউর অ্যাবল লিডারশীপ।’

পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগকে যখন রক্ষণশীল দল সম্পূর্ণভাবে দখল করে নেয়, তখন প্রগতিশীল গ্রুপের তরুণ কর্মী ও নেতাগণ ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আসাম প্রদেশ মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে কর্মী সম্মেলনে মিলিত হয়ে গঠন করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। এদিন শেরবাংলার সাথে চৌধুরী মঞ্চে উপস্থিত থাকলেও পরবর্তী নতুন দলে যোগ দেন নি ।

প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধী দলে একজন দূরদর্শিতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসাবে যেই ইতিহাস তৈরি করেছেন তা এখানে উল্লেখ না করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। আবুল হোসেন সরকারের কোয়ালিশন মন্ত্রী সভাতে (আমি তখন আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে এতে একজন মন্ত্রী ছিলাম)

ষাট দশকে তাঁকে দেখেছি দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট, জাতীয় সংসদের স্পিকার, একই সাথে কখনও ৮টি আবার কখনও ৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, সংসদের সরকার বিরোধী সদস্য হিসাবে আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও পূর্বাঞ্চলকে প্রতিরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করার দাবিতে সোচ্চার এক বলিষ্ঠ, দক্ষ, সহনশীল, চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসাবে। ড. এম শরীফ, কুদরতউল্লাহ্‌, সেহাব খুরশিদ আহমদের মত তৎকালীন জাঁদরেল আমলাগণ তাঁকে অত্যন্ত সমীহ করতে দেখেছি।

ফজলুল কাদের চৌধুরী সব সময় জনতার মানুষ হিসাবে নিজেকে দাবি করতেন এবং তাঁর প্রমাণও দিয়েছেন। ঢাকা হাই কোর্টের রায় বলে সাংবিধানিক আওতায় মন্ত্রীদের সদস্যপদ বাতিল হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় বা কোনো অঞ্চলের কোনো মন্ত্রীই মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে উপনির্বাচনে সাহস করে প্রতিদ্বন্ধিতা করেননি। কিন্তু জনাব চৌধুরী ‘আমি জনতার মানুষমন্ত্রীত্বের চেয়ে জনপ্রতিনিধিত্ব আমার জন্য শ্রেয়’ এ কথা ঘোষণা দিয়ে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করার মত অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় মুসলিম লীগের কর্মী হিসাবে এবং ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মম ও রহস্যজনকভাবে মৃত্যূবরণ করেন দলীয় প্রধান হিসাবে। একজন বিচারাধীন কারাবন্দীর অস্বাভাবিক মৃত্যূর রহস্য উদঘাটন করার সকল গণতান্ত্রিক শক্তির অধিকার যেমন প্রতিষ্ঠিত তেমনি মানবতার প্রশ্নও সুস্পষ্টভাবে জড়িত।

লেখক : হাশিমুদ্দিন আহমদ, রাজনীতিবিদ

পূর্ববর্তী নিবন্ধওমরগণি এম ই এস কলেজে জুলাই শহীদ স্মরণে আলোচনা সভা
পরবর্তী নিবন্ধমোঃ বাচ্চু