দায়িত্ব নিয়েই তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নবনির্বাচিত মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী। এগুলো হচ্ছে- মশার উপদ্রব কমানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়ন এবং দ্রুত গতিতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কার। এ তিন কারণেই প্রতিদিন দুর্ভোগ হয় নগরবাসীর। তাই মেয়রের কার্যতালিকায় এসব সমস্যার সমাধানে অগ্রাধিকার দেয়ার দাবি করেছেন নগরবাসী।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ অনুযায়ী, ২৮ ধরনের কাজ করার সুযোগ আছে মেয়রের। এর মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নালা-নর্দমা পরিষ্কার, সড়ক মেরামত ও সড়কবাতি নিশ্চিত অন্যতম। সাধারণত এসব বিষয় নিয়েই অতীতে কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন মেয়রগণ। কিন্তু মশক নিধন নিয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবুও প্রতিবছর মশক নিধনে নিজস্ব বাজেটে বরাদ্দ রাখে চসিক। আবার সরকারও সহায়তা করে। তাই মশক নিধনের কাজটিও বর্তায় চসিকের উপর। আজ সোমবার মেয়রের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন রেজাউল করিম চৌধুরী। অবশ্য নির্বাচিত হওয়ার পর দিন গত ২৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ১০০ দিনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। এতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় প্রথমেই হাত দিবেন জানিয়ে বলেছেন, তারপর রাস্তাঘাট সংস্কার ও মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করবেন।
মশক নিধন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : শহরে মশার উপদ্রব আগের চেয়ে বেড়েছে। দিনরাত মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ নগরবাসী। মশার কামড়ে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ছে তাদের। এরপরও কিন্তু মশক নিধনে এগিয়ে আসছে না চসিক। নগরবাসীর আহ্বান এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা কিছুই যেন কর্ণগোচর হয় না সংস্থাটির পরিচ্ছন্ন বিভাগের। নগরের মোহাম্মদপুর মাজার রোড এলাকার বাসিন্দা জাকারিয়া আহমেদ সিনান আজাদীকে বলেন, বাসার পাশেই নালায় রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ চলছে। এজন্য নালায় বাঁধ দেয়া হয়েছে। নালার স্থির পানিতে কিলবিল করছে মশার লার্ভা। বাসায়ও থাকতে পারছি না মশার যন্ত্রণায়। অথচ সিটি কর্পোরেশনের সেদিকে নজর নেই। গত কয়েক বছরেও এখানে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি।
এদিকে মশক নিধন কার্যক্রমকে গতিশীল করতে সম্প্রতি চসিককে তিনটি করণীয় ঠিক করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর অন্যতম ছিল ২০২১ সালের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন। মশক নিধনের এ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নও চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে মেয়রের সামনে। অবশ্য মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০১৯ সালেও একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। করোনা পরিস্থিতির কারণে সে কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
এদিকে নগরবাসীর অভিযোগ আছে, শৃক্সখলা হারিয়েছে চসিকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। গতি হারিয়েছে ২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘ডোর টু ডোর’ প্রকল্প। এছাড়া জালালাবাদ, পশ্চিম ষোলশহর, মোহরা ও পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকাসহ শহরের ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বাসাবাড়ি প্রকল্পটির আওতায় না আসায় ক্ষোভ আছে নগরবাসীর। অভিযোগ আছে, যেখানে-সেখানে ময়লা-আর্বজনা পড়ে থাকারও।
এছাড়া ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দিনের পরিবর্তে রাতে ময়লা অপসারণ কার্যক্রমটিও থমকে গেছে। এতেও ক্ষোভ আছে নগরবাসীর। দিনের বেলায় ময়লা অপসারণ করায় চলার পথে উৎকট দুর্গন্ধে নাকে হাত দিতে হয় পথচারীদের। রাস্তায় ফেলে রাখা ডাস্টবিনের কারণে সৃষ্টি হয় যানজটও। নগরবাসীর অভিযোগের সত্যতা মিলেছে সম্প্রতি সিএমপি থেকে চসিককে দেয়া একটি পত্রে। এতে রাত ১১ টা থেকে ভোর ৬টার মধ্যে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শেষ করার অনুরোধ করে সিএমপি। এছাড়া চসিকের ভাসমান ডাস্টবিন, স্তুপাকারে থাকা ময়লা ও আর্বজনা ভর্তি কন্টেনারের কারণে যান চলাচলে ব্যাঘাতসহ ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
সাইফুল আলম নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, সিটি কর্পোরেশনের প্রধান কাজগুলোর অন্যতম বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এ খাতে কোনো সময় শতভাগ বা কাছাকাছি সাফল্য দেখাতে পারেননি অতীতের কোনো মেয়র বা প্রশাসক। অবশ্য নিজেদের মত করে তারা চেষ্টা করেছেন। আশা করছি নির্বাচিত মেয়র সফল হবেন।
মশক নিধন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ‘প্রথমেই হাত দেব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। পরিচ্ছন্ন বিভাগকে গতিশীল করে পরিচ্ছন্ন শহর নিশ্চিতে চেষ্টা করব। শহরে মশার উপদ্রব খুব বেড়ে গেছে। নালা-নর্দমা পরিষ্কার না করে শুধু ওষুধ ছিটালে মশার বংশ বিস্তার বন্ধ হবে না। তাই সেদিকে সমান নজর থাকবে।’
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলের ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৭ পর্যন্ত অনুচ্ছেদে আর্বজনা অপসারণ, সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া আছে। এছাড়া আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল।
সড়ক সংস্কার : পোর্ট কানেকটিং রোড, বৌদ্ধ মন্দির সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক, সিরাজদ্দৌলা রোড, কেবি আমান আলী রোড, আইস ফ্যাক্টরি রোড, স্ট্যান্ড রোডসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো সড়কের অবস্থা বেহাল। ওয়ার্ড পর্যায়ে আভ্যন্তরীণ অনেকগুলো সড়কও আছে ভাঙাচোরা অবস্থায়। এতে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগে পড়ছেন পথচারীরা। এর মধ্যে পোর্ট কানেকটিং রোড এবং স্ট্যান্ড রোডের সংস্কার কাজ শেষ হচ্ছে না গত কয়েক বছরেও।
এদিকে গত বর্ষায় শহরের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতি হয়েছিল। কার্পেটিং ওঠে গিয়ে খানাখন্দ হয়েছে। সম্প্রতি অবশ্য প্যাচওর্য়াক করে অনেকগুলো সড়ক সংস্কার করেছে প্রকৌশল বিভাগ। এদিকে কিছু কিছু জায়গায় ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে নতুন করে ক্ষতি হয়েছে অনেক সড়কের।
সড়ক সংস্কার প্রসঙ্গে মেয়র রেজাউল বলেন, যেসব সড়ক এখনো খানাখন্দে ভরা সেগুলো সংস্কার করে যান চলাচলের উপযোগী করে তুলব। দায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথে তো একেবারে নতুন করে রাস্তা নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। তাই যেসব রাস্তায় গর্ত হয়ে গেছে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছে সেগুলো দ্রুত সংস্কার করে দেব, যাতে নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘব হয় এবং যান চলাচলে সুবিধা হয়। পাশাপাশি সড়কগুলো কীভাবে আরো টেকসই করা যায় সেজন্য প্রকল্প গ্রহণ করব।